ইকবাল হোসেন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চমক নতুন কিছু নয়। তবে কিছু চমক একেক সময় একেক রকম তাৎপর্য ও মাত্রা নিয়ে হাজির হয়, যার প্রতিটি ঢেউ জাতীয় রাজনীতিতে নতুন আলোচনার খোরাক জোগায়। সম্প্রতি বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিছক দলবদলের গল্প নয়-বরং এটি দেশের রাজনীতির অন্তর্নিহিত হতাশা, আদর্শিক শূন্যতা ও বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজের একটি বাস্তব প্রতিফলন।
গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে একের পর এক খবর আসছে-বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা দল ত্যাগ করে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিচ্ছেন। শেরপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, পিরোজপুর, জামালপুর, নাটোরসহ একাধিক জেলায় এ প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চুয়াডাঙ্গায় প্রায় ৪০০, মেহেরপুরে ৭০, নাটোরে শতাধিক নেতাকর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছেন। এ যোগদান শুধু পরিসংখ্যান নয়; বরং বিএনপির ভিতরে জমে থাকা অসন্তোষ, হতাশা ও দিকহীনতার একটি সরাসরি বহিঃপ্রকাশ। বছরের পর বছর রাজপথে সংগ্রাম করা, মামলা-হামলার মুখোমুখি হওয়া কর্মীরা এখন নিজেদের ‘বিচ্ছিন্ন সৈনিক’ মনে করছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা, আন্দোলনের দৃশ্যমান ব্যর্থতা, এবং সাংগঠনিক পুনর্গঠনের অভাব তাদের মধ্যে গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এ শূন্যতা থেকেই তারা খুঁজছেন নতুন আশ্রয়-আর জামায়াতে ইসলামী সেখানে একটি সংগঠিত, কাঠামোগত ও আদর্শভিত্তিক বিকল্প হয়ে উঠছে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ও রাজনৈতিক বাধার মুখে জামায়াতে ইসলামী কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, এটি সত্য। তবে নীরবেই দলটি নিজের ভেতর কাঠামোগত পরিবর্তন, নেতৃত্বে তরুণদের অন্তর্ভুক্তি, এবং মাঠপর্যায়ের কর্মসূচির মাধ্যমে পুনর্গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘সহযোগী সদস্য’ গঠনের কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূলে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির কৌশলগত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এ প্রক্রিয়ায় পুরনো কর্মীদের পাশাপাশি বিএনপির অসন্তুষ্ট কর্মীরাও নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাদের অনেকে জামায়াতের শৃঙ্খলাবদ্ধ দলীয় কাঠামো, আদর্শিক স্পষ্টতা এবং লক্ষ্যভিত্তিক রাজনীতিকে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থির ও দৃঢ় ঠিকানা হিসেবে বিবেচনা করছেন।
সমালোচকরা প্রশ্ন তুলছেন-বিএনপি থেকে জামায়াতে যাওয়া কি আদর্শগত রূপান্তর, নাকি কেবল রাজনৈতিক আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা? বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শ অনেক সময় বাস্তবতার চাপের মুখে গৌণ হয়ে পড়ে। তবে যারা এই স্থানান্তর করছেন, তাদের অনেকেই বিএনপির ভেতরে নেতৃত্বের সংকট, দিশাহীন আন্দোলন ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অন্যদিকে, জামায়াতে যোগদানের মাধ্যমে তারা একটি সক্রিয়, দিকনির্দেশনামূলক রাজনীতির অংশ হতে চাইছেন। তবে এটাও স্পষ্ট-আদর্শিক স্তরে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও একসময় রাজনৈতিক কৌশলের কারণে দুই দল কাছাকাছি এসেছে, তবে তা আদর্শিক ঐক্যের নয়, বরং বিরোধী রাজনীতির বাস্তব দাবির ফসল। অনেকেই মনে করেন, ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের এই দলবদল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ইতিহাস বলে, বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয় তৃণমূল থেকে। যেসব নেতাকর্মী একসময় দলের প্রাণ ছিলেন, তারাই যদি দলবদলের সিদ্ধান্ত নেন-তবে তা শুধু একটি ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নয়, বরং তা পুরো দলের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
এ প্রবণতা জামায়াতে ইসলামীর জন্য একদিকে যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে, তেমনি এটি একটি সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জও বটে। নতুন কর্মীদের আদর্শিকভাবে প্রস্তুত করা, সংগঠনের ভেতরে ঐক্য বজায় রাখা এবং একীভূত নেতৃত্বে পরিণত করাই এখন মূল পরীক্ষা। যদি এসব দিক সঠিকভাবে সামাল দেয়া না যায়, তবে এই নতুন ঢেউ খুব দ্রুতই স্তিমিত হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক দোলায়িত প্রবাহ-যেখানে হতাশা, প্রত্যাশা আর আদর্শ একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। বিএনপি থেকে জামায়াতে যোগদানের এ প্রবণতা কেবল একটি রাজনৈতিক স্থানান্তর নয়; বরং তা একটি বড় সামাজিক, আদর্শিক ও সাংগঠনিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এটি যেমন একদল ত্যাগী কর্মীর বেদনার গল্প, তেমনি অন্যদিকে একটি সংগঠিত আদর্শিক রাজনীতির নবজাগরণের ইঙ্গিত।
এ যাত্রা কতদূর যাবে, তা সময় বলবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতি নির্ধারণে এই ঘটনাগুলো অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এখন দেখার বিষয়, কে এই পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে, আর কে হারিয়ে যাবে অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে।
লেখক : সংবাদকর্মী