সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়িগণ আগামী বছর (২০২৬) বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তরণের বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার মতো পর্যায়ে নেই। তাই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবার সময় সীমা অন্তত ৩ থেকে ৫ বছর পিছিয়ে দেয়া হোক। এর আগে অন্য একটি ব্যবসায়ি সংগঠন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের চূড়ান্ত সীমা অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দেবার দাবি জানিয়েছিল। উল্লেখ্য,বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করে। জাতিসঙ্ঘ যে তিনটি সূচক বা শর্ত পূরণের উপর ভিত্তি করে একটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়ে থাকে বাংলাদেশ তার সবগুলোই অত্যন্ত ভালো ভাবে পূরণ করেছে। তবে সন্দেহ দেখা দিয়েছে অন্যত্র। বিগত সরকার আমল, বিশেষ করে আ হ ম মোস্তাফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত করে দেখানোর মাধ্যমে সরকারের কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এটা ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আচরণের মতোই। কোন এলাকায় ঝড় বা বন্যা হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তার ক্ষতির পরিমাণ বেশি করে দেখিয়ে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে যাতে সরকারি পর্যায়ে থেকে বেশি করে ত্রাণ সহায়তা পাওয়া যায়। আবার থানা পুলিশের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায় তাহলো তারা অপরাধের মাত্রা এবং পরিমাণ কম দেখানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে জিডি গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে একাধিক ঘটনাকে একটি মাত্র জিডিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এমনকি ডাকাতির মামলাকে তারা চুরির মামলা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাঝে এমন প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। কোন সূচকে খারাপ করলে সেই সূচক যতটা সম্ভব কম প্রদর্শন করা হতো। আবার কোন সূচকে কিছুটা ইতিবাচক অর্জন থাকলে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হতো। ফলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বেশির ভাগ তথ্য-উপাত্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
প্রতি বছরই একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে তাহলো, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হার প্রদর্শন করে তার সঙ্গে বিশ্বব্যাংক-ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে অন্তত ১ থেকে দেড় শতাংশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো। বছরান্তে কোন পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতো না। প্রশ্ন হলো, একটি নির্দিষ্ট বছরে কোন দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ভিন্ন হয় কিভাবে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশে বেকারের সংখ্যা প্রদর্শন করে ২৭ লাখ। এটা সম্ভবত কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না। সংস্থাটি উন্নত দেশের আদলে বেকারের সংখ্যা নিরূপন করে থাকে। প্রশ্ন হলো, উন্নত দেশ একজন বেকারকে নিয়মিত বেকার ভাতা প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে কি বেকার ভাতা দেয়া হয়? তাহলে উন্নত দেশের আদলে বেকারের সংখ্যা নিরূপন করা কি যৌক্তিক হবে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিগত সরকার আমলে অধিকাংশ তথ্য-পরিসংখ্যান বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রদর্শন না করে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক প্রদর্শন করতো বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকার আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাফল্য প্রদর্শনের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হতো। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবে এটা সরকারের জন্য এক বিরাট সাফল্য হিসেবে পরিগণিত হবে। সরকার সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। যেসব তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে তার সঠিকতা নিরূপন করা যেতে পারে।
বিগত সরকার উন্নয়নের নামে অর্থ অপচয় করেছে। এ অর্থ তারা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট ২৩ হাজার ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। অথবা ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের নামে অর্থ বের করে নিয়ে পাচার করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি সহযোগি সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশিদের ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে সংস্থাটি। উন্নযন প্রকল্পের নামে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে দেশকে কার্যত ঋণগ্রস্থ একটি দেশে পরিণত করা হয়েছে। বিগত সরকার আমলে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে,নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে অতীতে গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগামীতে অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বৈরাচারি সরকারে উদ্দেশ্য থাকে জনগণকে ধোকা দেবার জন্য অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধন করা। এতে অর্থ আত্মসাতের বিস্তর সুবিধা থাকে। আর বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হলে সরকারকে তেমন একটা জবাবদিহি করতে হয় না। স্বৈরাচারি সরকারের একটি কমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো তারা জনগণকে উন্নয়ন দেখানোর জন্য অবকাঠামোগত খাতে বেশি গুরুত্বারোপ করে। এ প্রবণতা আমরা পাকিস্তান আমলে আউয়ুব খানের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকার আমলে এবং সর্বশেষ বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে প্রত্যক্ষ করেছি।
আমরা অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হতে চাই তবে তা হতে হবে সঠিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে। মনগড়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়া গেলেও তা ধরে রাখা সহজ হবে না। বিগত ৫০ বছরে বেশ কয়েকটি দেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর আবারো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেমে যেতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ধরে রাখতে পারনি। কাজেই বাংলাদেশকেও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। যদি সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ অর্জন হয়ে থাকে তাহলে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোন অর্জন দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারে না। স্মর্তব্য, বিএনপি সরকার আমলে সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকালে একবার উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এম সাইফুর রহমান তাতে সম্মত হননি। কারণ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যেসব বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলে তার বেশির ভাগই হারাতে হবে। সে অবস্থায় বাংলাদেশের টিকে থাকাটাই কঠিন হতে পারে। কাজের উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার বিষয়ে আবেগ নয়,বাস্তবতার আলোকে বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কারণ একবার উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর আবারো যদি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেমে যেতে হয় তার চেয়ে লজ্জার আর কিছু থাকবে না। আমাদের নিকট প্রতিবেশি দেশ, সার্কের অন্যতম সদস্য নেপাল কয়েক বছর আগে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা প্রদর্শন করতে না পারার কারণে নেপালকে আবারো স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নামিয়ে দেয়া হয়েছে।
যে কোন দেশের জন্য উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশে পরিণত হওয়া অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। কিন্তু সে অর্জন কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। একবার উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর যদি আবারো স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নেমে যেতে হয় সেটা হবে অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং পরিতাপের বিষয়। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের ভালোমন্দ বিবেচনা করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপনকালে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’র (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার জন্য প্রস্তুত নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হয় তাহলে রপ্তানি খাতে বছরে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে। কারণ উন্নয়নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সব ধরনের শুল্ক সুবিধা হারাবে। উল্লেখ্য,আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানের পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জেনারালাইজড সিস্টের অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া কোটা সুবিধা এবং পরবর্তীতে সীমিত পরিসরে দেয়া জিএসপি (বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত আছে) সুবিধা বিশেষ অবদান রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে জিএসপি সুবিধা দিয়ে আসছে। জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকগণ বিনা শুল্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে। একক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশিদার এবং একক অঞ্চল হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তার প্রায় ৫০ শতাংশই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত তারা জিএসপি সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু তারপর জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তদস্থলে জিএসপি+নামে নতুন এক বাণিজ্যিক সুবিধা চালু করা হবে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পাবার জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হবে বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। এদিকে ভিয়েতনাম মার্কিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিকট থেকে জিএসপি সুবিধা পেতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সত্যি সত্যি ভিয়েতনামকে এ সুবিধা প্রদান করে তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আবেগ প্রবণ না হয়ে সবকিছু ভালোভাবে বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।