মোঃ শামীম মিয়া

আজকের পৃথিবীতে মানুষ যতটা সংযুক্ত, ততটাই বিচ্ছিন্ন। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিস্তারে আমরা এখন এক ভার্চুয়াল বাস্তবতার মধ্যে বাস করছিÑযেখানে মানবিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, সবকিছুই ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এক কৃত্রিম স্ক্রিনের আলোয়। সামাজিক মাধ্যম এখন আর শুধু যোগাযোগ বা তথ্যের প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক প্রকার মানসিক মাদক। মাদক শরীরকে নষ্ট করে, কিন্তু এ ডিজিটাল মাদক ধ্বংস করে মন, বোধ, ও আত্মার বিশুদ্ধতা। একে আজ আমরা বলছিÑসামাজিক মাধ্যমের অশ্লীলতা, যা সমাজের গভীরে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে মানুষ তা আর বিপদ হিসেবে দেখছে না, বরং আনন্দ, বিনোদন, বা আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করছে। কিন্তু এ অশ্লীলতা, এ ছদ্ম-বিনোদন, আসলে এক নিঃশব্দ ধ্বংসযজ্ঞÑযা মাদকের চেয়েও ভয়ংকর। মাদকাসক্ত মানুষকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি; তার চোখে ক্লান্তি, শরীরে দুর্বলতা, আচরণে উ™£ান্ততা থাকে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের অশ্লীলতায় আসক্ত মানুষকে চেনা যায় না। সে চুপচাপ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে, আঙুল চালায়, হাসে, মুচকি মন্তব্য করে, আবার অজানায় ডুবে যায়। সে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যায়Ñতার মনোযোগ ভেঙে পড়ে, চিন্তার গভীরতা হারায়, এবং বাস্তবতার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। সে এখন ‘লাইক’ ও ‘ভিউ’ নামক সংখ্যার দাস। এক লাইক মানে তার কাছে এক ডোজ ডোপামিন, এক কমেন্ট মানে মানসিক উত্তেজনা, আর এক ভিউ মানে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই আসক্তি যত সূক্ষ্ম, ততই ভয়ংকরÑকারণ এটি ধ্বংস করে মানুষকে ভেতর থেকে, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে।

অশ্লীলতা সব যুগেই ছিল, কিন্তু সামাজিক মাধ্যম সেটিকে দিয়েছে সীমাহীন গতি, সহজলভ্যতা, ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। এক সময় যেসব বিষয় সমাজের আড়ালে ছিল, আজ তা প্রকাশ্যে, সবার সামনে, বিনা সংকোচে প্রদর্শিত হয়Ñআর আমরা তাকিয়ে থাকি, হাসি, শেয়ার করি, লাইক দিই। এ অংশগ্রহণই অশ্লীলতাকে শক্তিশালী করেছে। আগে যেখানে ‘নিষিদ্ধ’ ছিল লজ্জার প্রতীক, এখন তা হয়ে গেছে ‘ট্রেন্ড’। তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে শরীর দেখাতে হবে, অঙ্গভঙ্গি দেখাতে হবে বা অন্তত ‘সাহসী’ হতে হবে। এ ‘সাহস’ আসলে এক প্রকার আত্মবিক্রয়, যা ধীরে ধীরে তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অশ্লীলতার বাজারের পেছনে আছে বিশাল এক ডিজিটাল অর্থনীতি। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর অ্যালগরিদম এমনভাবে কাজ করে যে, যে কনটেন্ট বেশি উত্তেজনা তৈরি করে, সেটাই বেশি প্রচার পায়। কারণ যত বেশি সময় মানুষ স্ক্রিনে থাকে, তত বেশি বিজ্ঞাপন দেখা হয়, আর তত বেশি টাকা আসে। ফলে এই অ্যালগরিদম এখন হয়ে উঠেছে ‘অশ্লীলতার জেনারেটর’। এটি জানে, মানুষ শরীর দেখতে চায়, বিতর্কে জড়াতে চায়, নিষিদ্ধের গন্ধ পেতে চায়Ñতাই সেটাই সামনে আনে এবং মানুষ না জেনেই তাতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এটি শুধু বিনোদনের সমস্যা নয়, এটি এখন সমাজবিজ্ঞানের সংকট। একদিকে পরিবারে সংলাপ কমে যাচ্ছে, সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে তরুণরা বাস্তব জীবনের সম্পর্কের চেয়ে ভার্চুয়াল সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মাদকের মতোই এ অশ্লীলতাও মানুষকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তরুণরা এখন সম্পর্ককে দেখে ব্যবহারিক চাহিদার চোখেÑস্নেহ, শ্রদ্ধা, সংযমের জায়গা নিচ্ছে শারীরিক আকর্ষণ ও অনুকরণ। মেয়েরা ভাবছে তাদের মূল্য নির্ভর করে বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপর, ছেলেরা ভাবছে আকর্ষণ মানেই আধিপত্য। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক বিকৃত যৌন-মনস্তত্ত্ব, যেখানে প্রেম বা শ্রদ্ধা নয়, বরং ‘দৃষ্টি কাড়ার প্রতিযোগিতা’ই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অল্প বয়সে অশ্লীল কনটেন্ট দেখার প্রভাব মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সেন্টার’-এ গভীরভাবে পড়ে। এতে কিশোররা সাময়িক আনন্দ পায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাদের মনোযোগ, একাগ্রতা, ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তারা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ‘ ডোপামিনের দাস’Ñযা আসলে মাদকের মতোই মস্তিষ্ককে পুনর্গঠন করে। আর এ পুনর্গঠন তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে এক গভীর একাকীত্ব, উদাসীনতা, এবং বাস্তব জীবনের প্রতি অনীহা। অভিভাবকদের দায়িত্বও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় তারা সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন, ভেবে নেনÑএতে সন্তান ব্যস্ত থাকবে, কষ্ট দেবে না। কিন্তু বুঝতে পারেন না, সে স্ক্রিনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক অন্ধকার, যা সন্তানের মস্তিষ্ক ও মানসিকতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। তারা হয়তো সন্তানকে স্কুলে পাঠান, কিন্তু সন্তান শিখছে ইউটিউব শর্টস বা রিল থেকেÑযেখানে সফলতা মানে দৃষ্টি আকর্ষণ, আর নৈতিকতা মানে পুরোনো ধ্যানধারণা। এই অবস্থায় রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্বও সীমাহীন। শুধুমাত্র আইন দিয়ে অশ্লীলতা রোধ সম্ভব নয়, কারণ এটি শুধু অপরাধ নয়Ñএটি এক মানসিক ও সাংস্কৃতিক রোগ। তাই প্রয়োজন ডিজিটাল সাক্ষরতা, নৈতিক শিক্ষা, এবং সচেতন অভিভাবকত্ব।

স্কুল-কলেজে যেমন বিজ্ঞান বা গণিত শেখানো হয়, তেমনি শেখাতে হবে ডিজিটাল আচরণের নৈতিকতা, অনলাইন কনটেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ববোধ, ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা। একই সঙ্গে, সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি কনটেন্ট রেগুলেশন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে, তাহলে এই প্রবণতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যেমনটি অনেক দেশে হচ্ছেÑযেখানে অশালীন বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কনটেন্ট দ্রুত ব্লক করা হয়, শিশুদের জন্য আলাদা সুরক্ষিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেও এ ধরনের নীতিমালা জরুরি, নইলে এই ‘ডিজিটাল মাদক’ পুরো প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেবে। অবশেষে বলতে হয়Ñআজকের এই সময়টায় আমরা এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে বেঁচে আছি। একদিকে প্রযুক্তি আমাদের সামনে এনেছে অগণিত সম্ভাবনা, অন্যদিকে সে প্রযুক্তিই আমাদের চিন্তা, মনন, ও মানবিকতাকে ক্ষয় করছে। মাদক নিষিদ্ধ করলে মানুষ সতর্ক হয়, কিন্তু অশ্লীলতা যখন বিনোদনের নামে আসে, তখন মানুষ সতর্ক হতে ভুলে যায়। তাই এখন সময় এসেছে এ অদৃশ্য মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। সামাজিক মাধ্যমের অশ্লীলতা শুধু নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, এটি এখন প্রজন্মের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। যদি আমরা এখনই না জাগি, যদি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র একসঙ্গে এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়, তবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম হারাবে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা, হারাবে ভালোবাসার বিশুদ্ধতা, আর হারাবে মানুষ হয়ে ওঠার শক্তি। মাদক এক শরীরকে নষ্ট করে, কিন্তু এ অশ্লীলতাÑধ্বংস করে পুরো জাতির আত্মাকে।

লেখক : শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট আমদিরপাড়া, গাইবান্ধা।