DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বাংলাদেশ রেলওয়ে : একটি পর্যালোচনা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ও খুনি হাসিনার পতনের পর নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করে দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে খুনি হাসিনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দেশী ও বিদেশী একটি ষড়যন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। তাদের এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে পরিবহন,

Printed Edition

॥ ড. মো. নূরুল আমিন ॥

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ও খুনি হাসিনার পতনের পর নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করে দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে খুনি হাসিনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দেশী ও বিদেশী একটি ষড়যন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। তাদের এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে পরিবহন, পোশাক শিল্প, শিক্ষাখাত ও সরকারি ও বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ে সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আওয়ামী অর্থপুষ্ট একটি শ্রেণি এর জন্য নতুন সরকারের অযোগ্যতাকে দায়ী করছেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের সাম্প্রতিক ধর্মঘট ও তার ফলে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ এই ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ বলে দেশপ্রেমিক মহল মনে করেন। বাংলাদেশে রেলপরিবহন ব্যবস্থা চালু হয় ১৬৩ বছর আগে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ শাসকদের প্রচলিত এই পরিবহনটি মানুষ সহজে গ্রহণ করেছিল। রেল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তারা সম্মানের চোখে দেখতো। রেলের চাকরি একটা রাজসিক চাকরি ছিল। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই রেল পরিবহন সংস্থাটি এখন সারাদেশে বিস্তৃত এবং রেল ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি ডিভিশনে বিভক্ত- ইস্ট জোন এবং ওয়েস্ট জোন। একজন মহাপরিচালক এর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন।

বর্তমানে ২৭,৫৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এর সাথে জড়িত। বাংলাদেশ রেলব্যবস্থার দৈর্ঘ্য ৩,৬০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে মিটার গেজ ২০২৫ কিমি, ব্রড গেজ ১৫৭৫ কিলোমিটার। এই ৩,৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে আবার ডুয়েল গেজের পরিমাণ হচ্ছে ১৬০০ কিলোমিটার। সারা দেশে রেলওয়ের তৈরি ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা ৩৬৫০টি। এর মধ্যে আয়তনে বড় ৫৪৬টি, ক্ষুদ্র ৩১০৪টি। দীর্ঘতম ব্রিজগুলোর মধ্যে রয়েছে : পদ্মা ব্রিজ, ৬২৫০ মিটার (ব্রড গেজ), রূপসা ব্রিজ, ৫১৩০ মিটার (ব্রড গেজ), বঙ্গবন্ধু ব্রিজ ৪৮০০ মিটার (ডুয়েল গেজ), হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১৮৪৯ মিটার (ব্রড গেজ) ও মেঘনা ব্রিজ ১০২৪ মিটার (মিটার গেজ)। সারাদেশে রেলস্টেশনের সংখ্যা হচ্ছে ৪৯৮টি। গড়ে প্রতিবছর সাড়ে চার কোটি থেকে ৫ কোটি লোক ট্রেনে যাতায়াত করে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালাধীনে ৩১২টি ব্রড গেজ ও ১১৬৪টি মিটার গেজ কোচ আছে। এই এজেন্সিটি ৯০টি ইন্টারসিটি ট্রেন, ৫২টি মেইল বা এক্সপ্রেস ট্রেন, ৬২টি ডেমু বা কম্যুটার ট্রেন, ১৩৫টি শাটল বা লোকাল ট্রেন এবং দুটি আন্তর্জাতিক ট্রেন পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও ভারতের কোলকাতার মধ্যে যাতায়াতকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস ও ঢাকা-পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী হয়ে নিউজলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন সপ্তাহে দু’দিন দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। বলাবাহুল্য ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে রেল যোগাযোগ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর হাসিনা সরকারের আমলে তা পুনঃস্থাপন করা হয়।

আগেই বলেছি বাংলাদেশ রেলওয়ে ঐতিহ্যবাহী একটি রাজকীয় প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে এর মালিকানায় প্রায় ৬০,০০০ একর জমি আছে। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন প্রবর্তনের প্রথমদিকে মোবাইল কোম্পানিগুলো রেলওয়ে টাওয়ারসমূহকে ব্যবহার করেই যাত্রা শুরু করেছিল। সৈয়দপুরের রেলওয়ে কারখানা এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কারখানা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এত সমৃদ্ধশালী হওয়া সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর লোকসান দেয়। বছরের পর বছর এর সম্পদ ক্ষয়, দুর্নীতি, ক্ষমতাশালী মহল থেকে নিয়োগকর্মে হস্তক্ষেপ এবং মামলা-মোকদ্দমা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি রেলব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।

রেল শ্রমিক লীগ রেলওয়ে পরিবর্তনে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। রেলওয়ের সম্পদ সংরক্ষণে তাদের অবদান খুবই কম। এরশাদ আমলে চট্টগ্রামে রেলগাড়ির তেল চুরির একটি বড় ঘটনা ধরা পড়ে। কিন্তু ইউনিয়ন কর্তৃক অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। দেশে ফি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে। এর সাথে যাত্রীসংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু রেলের যাত্রী বাড়ছে না। প্রাইভেট বাস মালিকদের সাথে যোগাসাজশ করে রেলের সময়সূচি তৈরি করাই এর অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। অভিযোগ করা হয় যে, বাস মালিকরা রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পয়সা দিয়ে বশ করে এমন এক সূচি তৈরি করান যে সূচি যাত্রীদের অনুকূল নয়। ফলে যাত্রীরা রেলের চেয়ে বাসে যাতায়াতকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এর সাথে আবার ট্রেনের ধীরগতি, যাত্রা বাতিল ও বিলম্ব এবং নিরাপত্তা সমস্যাও রয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই রেললাইনের স্লিপারসমূহকে মজবুত করার জন্য নুড়ি পাথর দিয়ে গ্রাভেট প্যাকিং করা হয়। যাতে করে ট্রেন চলাচলের সময় প্লেটগুলো নড়চড় হয়ে না যায়। এখন দেখা যায়, মূল্যবান কাঠের তৈরি স্লিপার এবং গ্রাভেল প্যাকিংয়ের জন্য প্রদত্ত নুড়ি পাথরগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে রেলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। রেলই একমাত্র এজেন্সি যার নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষী বা পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তাদের ডিউটি কী?

রেলওয়ের জনবল কম বলে রেল বিভাগের তথ্য সঠিক বলে আমি মনে করি না, ১৯৭০ সালে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৫৫,৮২৫ জন, ১৯৮০ সালে ৫৮,১০৭ জন, ২০০০ সালে ৩৬৬০৩ জন এবং ২০১৫ সালে ২৮৩৫৩ জন। বর্তমানে ২৭,৫৩৫ জন। কাজের অনুপাতে তাদের সংখ্যা বেশি এবং আমি ঢাকা-কক্সবাজার ভ্রমণকালে নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছি। নব্বই-এর দশকের প্রথমদিকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনায় Structural Adjustment Programme-এর আওতায় এবং এর আগে এনাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজের ভিত্তিতে রেলওয়ের ৪৫ হাজার কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক-এর মাধ্যমে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঐ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তথাপি সময়ে সময়ে জনবল নিয়োগের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কারণ বছরে গড়ে পুরাতন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে ২০০ জন ও তার বেশি লোক অবসর গ্রহণ করেছে। কিন্তু দুর্নীতি, কর্তৃপক্ষীয় হস্তক্ষেপ, ইতোপূর্বে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ায় উচ্চ আদালতে ৪০টিরও বেশি রিট পিটিশন দায়ের করার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ২০১১ সালে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৪৮৯২ জন কর্মচারী নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই উদ্যোগের সাথে সাথেই সেখানে তার কালো বিড়াল ধরা পড়ে। প্রক্রিয়ার মাঝখানে এসে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক ঘুষ নেয়া শুরু হয় এবং ঢাকার বিডিআর গেইটে একটি মাইক্রোবাসে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় নেয়ার সময় তার এপিএস রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী ও সিকিউরিটি কমান্ডার ইনামুল হক ধরা পড়েন। মন্ত্রী তার মন্ত্রিত্ব হারান এবং পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট দু’জন কর্মকর্তার জেল হয়েছে বলে জানা গেছে।

কিন্তু ঘুষের এই বিরাট কেলেঙ্কারি থেকে অনেকে রেলওয়ে গেট কেলেঙ্কারি হিসেবে অভিহিত করেছেন- যিনি ধরার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন সেই ড্রাইভার আবদুল আওয়ালকে গুম করা হয়েছিল, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার পিতা সাংবাদিক সম্মেলন করে সরকার ও দেশবাসীর সাহায্য কামনা করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

রেলওয়ে কর্মচারীদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান বলতে হবে। তারা রেলের কোয়ার্টার বরাদ্দ পান। এই কোয়ার্টার শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়া দেয়া হয় এবং এই ভাড়া তাদের নিয়মিত আয়ের একটি উৎসও।

রেলওয়ের কিছু টেকনিক্যাল পদ আছে যেগুলো খালি রাখা যায় না। রেলওয়ে ড্রাইভার ও তাদের (সহকারীর লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার) পদ সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল। একজন ড্রাইভার হতে হলে কমপক্ষে আট বছরের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। জানা গেছে, এই পদে লোক না থাকায় রেলওয়েকে ৮৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ড্রাইভারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়েছে। তাদের যদি সঠিক জনশক্তি পরিকল্পনা, অবসর ও প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা থাকতো তাহলে তারা সহজে সংকট মোকাবেলা করতে পারতেন। রেলওয়েকে গতিশীল ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সামগ্রিক এই সিস্টেমটির ওভারহোলিং প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। জনবহুল এই দেশে এই ঐতিহ্যবাহী পরিবহন সংস্থাটি মানুষের কল্যাণে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।