মোঃ হাবিবুল্লাহ বাহার

গত ২১ জুলাই মাইলস্টোনের সে বিকেলটি আমরা কেউ ভুলতে পারব না। এটি দেশের ইতিহাসে এক করুন ট্রাজেডি হয়ে থাকবে। শহরের প্রান্তে সামরিক বিমানের ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। চারদিকে ধোঁয়া,আতঙ্ক আর কান্নার শব্দ। মানুষের দৌড়ঝাঁপ, বিস্ফোরণ মৃত্যুর ভয়, আর অসংখ্য শিশুর বাঁচার চিৎকার। এর মধ্যেও ভেতরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। একজন সাধারণ শিক্ষিকার অদম্য সাহস। তার নাম মেহেরিন ম্যাম। একজন শিক্ষক, একজন পরম মমতাময়ী অভিভাবক, যিনি সে বিপদসংকুল মুহূর্তে নিজের জীবন বাজি রেখে দৌড়েছিলেন তাঁর শিক্ষার্থীদের দিকে। ভয়ংকর বিপদের মাঝেও তিনি একে একে শিক্ষার্থীদের বের করে আনছিলেন, ঠেলে দিচ্ছিলেন নিরাপদ স্থানে। তাঁর নিজ শরীরের প্রতি কোনো খেয়াল ছিল না। চারপাশে আগুন, ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপ, তবু তিনি একেকজন শিশুকে বাঁচাতে ব্যস্ত।

নিজের জীবন দিয়ে হলেও যতজনকে পারা যায় বাঁচানো,এমনটাই ছিলো তার ভাবনা।হয়তো শেষ মুহূর্তে তাঁর মনে ছিল-“আমার ছাত্রছাত্রীদের কিছু হলে আমি বাঁচব কিভাবে?” এ ছিল তাঁর ভালোবাসা, তাঁর কর্তব্যবোধ, তাঁর মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা। তিনি অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে তিনি বাঁচিয়েছেন-এমনটাই বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। প্রকৃতির চরম বাস্তবতায় ছাত্রদেরকে বাঁচানো সে পরম মমতাময়ী মা তাদের ছেড়ে চলে যান। এমন করুন সময়ে জীবনের বিনিময়ে শিক্ষিকার এমন ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এমন সময় তার এমন ভূমিকার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি যথা সম্মান সবার প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু মিলেনি। এ ঘটনায় তেমনি মাইলস্টোনের আরেকজন মানবতার গুরু হলেন মাসুকা বেগম নিপু ও।

দুর্ঘটনায় পাইলট লেফটেন্যান্ট তৌকির সাগর ও প্রাণ হারিয়েছিলেন। রাষ্ট্র তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিল। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিন, সামরিক বাহিনীর গার্ড অব অনার, দেশের বড় বড় আমলাদের শোকবার্তা-সবই ছিল। আমরাও সবা সেই দৃশ্য দেখেছি,মন থেকে তাকে স্যালুট দিয়েছি, সবাই শ্রদ্ধা জানিয়েছি। কিন্তু একই দুর্ঘটনায়, যিনি নিজের জীবন দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বাঁচালেন-মেহেরিন ম্যাম। তাঁর জন্য ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কোনো শোকবার্তা! ছিলোনা বিদায়ের শেষ সময়েও কোনো মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্তার উপস্থিতি। না ছিলো কোনো স্মরণসভা, না কোনো সম্মাননা। শুধু পরিবার, সহকর্মী আর ক’জন শিক্ষার্থী ও গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের কান্নার ভেতর দিয়েই শেষ হলো মেহেরিন ম্যামের বিদায়যাত্রা। ঠিক একইভাবে দাফন সম্পন্ন হয় মাসুকা বেগম নিপু ম্যামের ও।

আমাদের রাষ্ট্রের অবকাঠামো ও দৃষ্টি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেন রাষ্ট্রের চোখে পরিচয়ই হলো সবকিছু। পরিচয়ের কারণেই নিজের জীবনের বিনিময়ে এ ত্যাগের জন্য পেলেন না তারা কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কিংবা সম্মান। অথচ তিনি তার এ চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষকতার মহান পেশাকে করেছেন সম্মানিত। সাধারণ মানুষেরা তার এই ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে সারা জীবন ইতিহাসের পাতায় স্মরণ করবে ও শিক্ষকরা ধারণ করার চেষ্টা করবে। এ দেশের আগামীদিনের কর্ণধারগুলোকে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা বাঁচিয়েছেন। তাহলে তারা কেন রাষ্ট্রের চোখে একটুও সম্মানিত হলেন না? এখন জনমনের ভিতর একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরছে শেষ সময়েও তারা কেন শিকার হলেন রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের?

কারণ, মেহেরিন ম্যাম ও মাসুকা ম্যাম ছিলেন মাইলস্টোনের একজন সাধারণ শিক্ষিকা! আমাদের সমাজে যেন অঘোষিত এক নীতি চালু আছে যে, সাহসের মূল্যায়ন হয় পদবী দিয়ে। এদেশের ব্যবস্থা এমন যে, আপনি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন, আপনার জন্য থাকবে বিশেষ ট্রিটমেন্ট। কিন্তু আপনি যদি হন একজন সাধারণ শিক্ষক-একজন সাধারণ নাগরিক-তবে আপনি এসব স্পেশালিটি থেকে বঞ্চিত হবেন এবং আপনার বীরত্বকে রাষ্ট্র ‘অভ্যাসগত উদাসীনতা’র ভেতর হারিয়ে ফেলবে।

ইতিহাসের আয়নার দিকে তাকালেই আমাদের চোখে পড়ে এ বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকান। আমাদের বীরশ্রেষ্ঠদের তালিকায় একজনও সিভিলিয়ান নেই। ইতিহাসের গভীরে গেলে দেখা যায়–গ্রামের কৃষক, শহরের শ্রমিক, তরুণ ছাত্র, নাম না-জানা অসংখ্য মানুষ লুঙ্গি কাছা মেরে, হাতে দা-কুড়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। তাদের ত্যাগেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ইতিহাসে তাদের স্মরণ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি এতটাই নামমাত্র যে আজকের প্রজন্ম খুব কমই তাদের গল্প জানে। এ সাধারণদের নাম আজ ইতিহাসে লেখা নেই, তাদের প্রকৃত অবদান আজও আলোচনার আড়ালেই থেকে গেছে।

মেহেরিন ম্যাম ও মাসুকা ম্যামের ঘটনাও সে পুরনো ইতিহাসেরই এক তাজা প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রের চোখে সাধারণ মানুষের বীরত্বের মূল্য আজও নামমাত্র। এত বড় একটি ট্র্যাজেডি, এত বড় তাদের আত্মত্যাগ-তবু কোনো শোকবার্তা নেই। কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি নেই। কোনো ফুলেরতোড়া নেই, নেই একটি সরল সরকারি বিবৃতিও! মনে হয় যেন কিছুই ঘটেনি। অথচ তারাই রাষ্ট্রের আগামী দিনের ফুলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন।

রাষ্ট্র যখন এমন নীরব থাকে, তখন হয়তো পুরো সমাজের কাছে একটি ভুল বার্তা চলে আসে যে “তোমরা যতই ত্যাগ করো, যদি তোমরা সাধারণ মানুষ হও, তোমাদের কেউ মনে রাখবে না। হারিয়ে যাবে রাষ্ট্রের অভ্যাসগত উদাসীনতা ও অবহেলার মাঝে।” আমরা প্রায়ই বলি “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।” কিন্তু বাস্তবে সে মেরুদণ্ড ভেঙে গেলেও রাষ্ট্রের কোনো অনুভূতি জাগে না। একজন শিক্ষক কেবল পাঠ্যবই পড়ান না, তিনি মানুষ গড়েন। আর এই মেহেরিন ম্যাম, মাসুকা ম্যাম তো সেই মানুষ গড়ার পাঠকে জীবনের শেষ মুহূর্তেও বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন।

তারা আমাদের শেখালেন-শিক্ষক মানেই কেবল ক্লাসরুম নয়, শিক্ষক মানেই আদর্শ, সাহস আর আত্মত্যাগ। যা ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা স্যার আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তবু এমন মহান শিক্ষিকাদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ আয়োজন নেই-তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রের কোন বিবৃতি নেই, কিছুই নেই এটাই আমাদের জন্য দুঃখজনক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্হার চরম বাস্তবতা।

তবুও পাওয়া না পাওয়ার মাঝেও মেহেরিন ম্যামদের গল্প আমাদের হতাশার ভেতরে এক আলোর রেখা। রাষ্ট্র তাঁকে সম্মান না দিলেও মানুষের হৃদয় তাঁকে সম্মান দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের চোখে তিনি আজ এক অমর এক নায়িকা। সহকর্মীদের চোখে তিনি সাহসের প্রতীক। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর নাম—‘‘সত্যিই এই দেশ এমন শিক্ষিকা খুব কমই দেখেছে।” এ স্বীকৃতিই আসল স্বীকৃতি, যা কোনো পতাকা বা প্রটোকলের চেয়ে অনেক বড়।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।