প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
যাকাত ও সাদাকা সমবিধানমূলক শব্দ । সালাত-সাওমের মতোই যাকাত-সাদাকা আদায় করা ফরয বিধান।
২য় হিজরিতে মদিনায় মুসলমানদের ওপর যাকাত ফরয হয়। শরী’আতের পরিভাষায় যাকাত হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। নিজের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব, মিসকিন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করাকে যাকাত বলা হয়। যা আল্লাহ তা’আলা দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য একটি অপরিহার্য মানবিক কাজ হিসেবে সম্পদশালীদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। আল্লাহর বাণী আল কুরআনে ৮২ বার সালাত ও যাকাত (যাকাত শব্দ ৩০ বার, আল ইনফাক শব্দ ৪৩ বার, আস সাদাকাহ শব্দ ৯ বার =৮২) আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “আকীমুস সালাহ ওয়া আতুয যাকাহ”-এ পরিভাষায় আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, তোমারা অবশ্যই সালাত (নামায) আদায় করো এবং যাকাত প্রদান করো।
রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্টহারে যাকাত আদায় করে নিঃস্ব, দরিদ্রের মাঝে তা পৌঁছিয়ে দিলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন হবে। দেশের সমস্ত মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত খিলাফতে রাশেদা ও পরবর্তীতে দ্বিতীয় উমর উমর বিন আবদুল আজিজের শাসনামলে যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্প ক’বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রে আর যাকাত নেওয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আমাদের দারিদ্র্য কবলিত বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সঠিক হিসেবে প্রত্যেক যাকাতদাতা থেকে যাকাত আদায় করে প্রকৃত দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করলে দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে। এ জন্য প্রয়োজন ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। নামাযভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে। যাকাত মানুষের অর্থকে সংকুচিত করে না। বরং বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধ ও নিরাপদ করে।
নামাযভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মানুষেরা আহকামুল হাকিমীন আল্লাহর শাস্তির ভয়ে যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “নিশ্চয়ই নামায মানুষদেরকে অন্যায়-অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে।”-সূরা- আল আনকাবুত, আয়াত-৪৫
আর সমাজে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হয়ে একটি সচ্ছল ও ভারসাম্যপূর্ণ মানবজীবন নিশ্চিত হবে। যাকাতপ্রাপ্তি নিঃস্বদের অধিকার। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা : “তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” -সূরা- আয যারিয়াত-১৯
যাকাত শব্দের অর্থ : যাকাত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। যাকাত অর্থ-সম্পদকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে। মানুষের মন-মস্তিষ্ককে গর্ব, অহংকার, লোভ-লালসা ও কৃপণতার মলিনতা থেকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখে। আল্লাহ তা’আলার সব বিধান মানবিক ও বিজ্ঞানসম্মত, শোষণমুক্ত। কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে সীমাহীন অহংকারী হবে, আর কেউ নিঃস্ব হয়ে পথের ভিখারি ও পরমুখাপেক্ষী হবে, ইসলাম তা কখনো সমর্থন করে না।
যাকাত ফরয যাদের ওপর : নিসাব পরিমাণ সম্পদশালীর ওপর যাকাত আদায় করা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য। কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং সেই সম্পদ এক বছর হাতে থাকে ও ঋণমুক্ত থাকে তাহলে তাকে ৪০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ আড়াই পার্সেন্ট যাকাত দিতে হবে।
যাকাতের নিসাব : ১. স্বর্ণ-২০ মিসকাল অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা (৪৭৮০৮৭ গ্রাম)
২. রুপা-২ শত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬২১০৩৫ গ্রাম)
৩. নগদ অর্থ-সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য
৪. ব্যবসায়িক পণ্য-সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য
৫. সমমূল্যের বন্ড, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, ডি পি এস, ফিক্সড ডিপোজিট।
উল্লেখ্য, জমি, ঘর, বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট- এগুলোতে যাকাত আসে না। তবে যদি এগুলো ব্যবসায়ের জন্য হয়, তাহলে যাকাত আসবে। -সুনানে দারে কুতনি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৭৮; ফাতহুল কাদির, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২২১; হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৯৪।
যাকাত বা সাদাকার উদ্দেশ্য : যাকাত বা সাদাকার মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাদের ওপর সাদাকা ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে নেওয়া হবে এবং তাদের গরিবদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।” - বুখারি-মুসলিম, সংকলিত মিশকাত, হাদিস-১৭৭২ যাকাত অধ্যায়।
যারা যাকাত-সাদাকা প্রাপ্তির যোগ্য : আল্লাহ তা’আলা সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে ফরয সাদাকা-যাকাত প্রদানের ৮ টি খাত বর্ণনা করেছেন:
১. ফকির : নিঃস্ব, ভিক্ষুক
২. মিসকিন : যে ব্যক্তি প্রকৃতই অভাবগ্রস্ত, কিন্তু মুখ খুলে কারও কাছে চায় না, নিজের দারিদ্র্য প্রকাশ করে না। কাছের লোকেরা তাকে বুঝে নিয়ে যাকাত দেবে।
৩. আমেলিন : যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ
৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্টকরণে : অমুসলিমদেরকে ইসলামে প্রবেশ করানোর জন্য প্রণোদনের উদ্দেশ্যে
৫. দাসমুক্তির জন্য : বর্তমান দাসপ্রথা নেই বলে এ খাত কার্যকর হচ্ছে না, তবে অসহায় মুসলিম বন্দিদের মুক্তির জন্য কার্যকর হতে পারে
৬. ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি : সম্পদের তুলনায় যার ঋণের বোঝা বেশি, সম্পদ নেই, প্রকৃতই ঋণগ্রস্ত, উভয়ে যাকাতের হকদার
৭. ফী সাবিলিল্লাহ : আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রামে
৮. দুস্থ মুসাফির : কোনো বিপদগ্রস্ততায় পথিমধ্যে পাথেয়শূন্য ব্যক্তি, পূর্বে সম্পদশালী থাকলেও।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত আদায় ও বণ্টন :
রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় যাকাতদাতাদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক সঠিক হিসেবে যাকাত আদায় করে প্রকৃত দুস্থ মানবতার মধ্যে যাকাতের অর্থ বিতরণ করলে অতি দ্রুত দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা জাগ্রত হবে। দরিদ্রতা দূর হলে মানুষ কাজে-কর্মে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। মানুষের মধ্যে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাবে। মানুষ স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবে। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সৎ, যোগ্য ও নৈতিকতাসম্পন্ন ইসলামি নেতৃত্ব ও ইসলামি শাসন ব্যবস্থা।
আল্লাহ তা’আলা সালাত ও যাকাত ভিত্তিক বৈষম্যহীন, একটি মানবিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য আপামর জনসাধারণকে জেগে উঠার তাওফিক দান করুন। আমীন!
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কবি।