আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম জাতির জন্য সৌভাগ্যের পুরুস্কার স্বরূপ বছরে দুটি ঈদ দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতর আরেকটি হলো ঈদুল আযহা। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, উৎসব বা বারবার ফিরে আসা। আর ‘আযহা’ শব্দটির অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ বা কুরবানির পশু যবেহ করা ইত্যাদি। কুরবান শব্দের অর্থ নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ। উল্লেখিত শব্দ এবং অর্থগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ত্যাগ বা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের যে চেষ্টা করা হয় তাকেই ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানির ঈদ বলে। প্রচলিত অর্থে কুরবানি হলো পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে নিয়ত করে পশু যবাই করা। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি।’
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো।’ (সূরা কাওসার, আয়াত-২) অনুরূপভাবে রাসূল (স.) ইরশাদ করেছেন, কুরবানির দিনে মানব সন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট এত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কুরবানি করা। আর কুরবানির পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো (তিরমিযী)।
যাকাতের মতো কঠোর নির্দেশও আছে। মানুষ শুধু ইসলামকে ভালোবাসি ভালোবাসি বললেই হবে না তার প্রমাণ ও পরীক্ষাও দিতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে (ইবনে মাযাহ)। তাহলে কি বুঝা গেল? ঈদ শুধু আনন্দের নয়, কর্তব্য পালনের পরীক্ষাও।
মানব ইতিহাসে কুরবানির বিষয়টি সুপ্রাচীন। যার ভাবার্থ কুরবানির ত্যাগের মাধ্যমে সাওয়াব লাভ করা। সকল নবীগণের জন্যই কুরবানির (পরীক্ষা) দিতে হয়েছে। কেউ দেশ ত্যাগে কেউ নিকটাত্মীয় ত্যাগ করে, আর কেউ জীবনের হাসি আনন্দ ও সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুকে ত্যাগ করে, নিজেকে দিয়ে নজরানা পেশ করেছেন। যাঁরা অলী আল্লাহ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন তাঁরাও নিরলসভাবে আল্লাহর সান্যিধ্য পাওয়ার জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছেন।
আমরা বর্তমানে যে কুরবানি করে থাকি তা মুসলিম জাতির জনক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নত হিসেবেই করি। তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে নিজের সর্বপ্রিয় পুত্রকে কুরবানি করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ত্যাগের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। এ বিষয়টি আল্লাহর নিকট এতই গ্রহণযোগ্য হয়েছে যে, আমাদের ওপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরবানির নির্দেশনা ত্যাগ-তিতীক্ষার সেই উদাহরণকে কিয়ামত পর্যন্ত শিক্ষণীয় হিসেবেই জীবন্ত করে রেখেছেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানি দেয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এরপর তিনি ১০টি উট কুরবানি করেন। আবারো একই স্বপ্ন দেখেন নবী ইব্রাহীম (আ.)। এবার তিনি ১০০টি উট কুরবানি করলেন। তৃতীয়বার যখন একই স্বপ্ন দেখলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমার কাছে প্রিয় বস্তু একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল (আ.) ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলত তিনি যে মানের তাঁর ত্যাগও হবে সেই মানের। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাও তাই ছিলো।
ইব্রাহীম (আ.) বিষয়টি নিয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.) এর সাথে মতামত চাইলেন, কুর- আনের ভাষায়- “হে বৎস! নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে যবাহ করছি। সন্তানের পক্ষ থেকে উপযুক্ত জবাব ‘আববাজান! আপনি যে বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে আদিষ্ট হয়েছেন, তা পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)
আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও মা হাজেরা কুরবানির জন্য কলিজার টুকরা পুত্রকে সাজিয়ে নিলেন। আমাদের কুরবানি কি এমন আত্মত্যাগের নমূনা হয়? আমরা কি স্মরণ করি আল্লাহর পরীক্ষা চলছে আমাদের আর্থিক কুরবানির মধ্য দিয়ে? বালক ইসমাঈল (আ.)কে মা-বাবা এমন শিক্ষা দিয়েছেন যে সেও নিজের জানকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। আল্লাহর প্রেমিক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ধারালো ছুরি হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর ঈমানী শক্তির কারণে একটি পশমও কাটতে পারেনি। তার পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে জিব্রাইল (আ.) বেহেশত থেকে জান্নাতি দুম্বা এনে ইসমাঈল (আ.)-এর স্থলে রাখলে তা কুরবানি হয়ে যায়।
ঈমানের সর্বোচ্চ নমূনা হলো আল্লাহর এ বাণী- ‘বলো, আমার সালাত, আমার হজ্জ ও কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে।’ (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২) যিনি এমন মানসিকতা রাখবেন আল্লাহ তার উপরই সন্তুষ্ট থাকবেন। হয়তো তার কুরবানিই কবুল হবে, ইনশাআল্লাহ।
যার ওপর যাকাত ফরজ তার ওপর কুরবানিও ওয়াজিব। (অর্থাৎ ১০ জিলহজ্জের ফজর হতে ১২ জিলহজ্জের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পারিবারিক প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি যদি ‘নেসাব’ পরিমাণ মালের মালিক হয়, তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। শরীয়তের ভাষায় নেসাব পরিমাণ মাল বলা হয়, সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ কিংবা তৎসম মূল্যের সম্পত্তির বাংলাদেশি টাকা।) এখানেও একটি হেকমত দেখেছেন? সোনা রূপা যাই হোক না কেন, এর অর্থ হলো যে দেশে যে টার মূল্য প্রাধান্য পায় সে জন্য দুটি মূল্যবান সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন।
নিজের কুরবানির পশু নিজ হাতেই যবাই করা মুস্তাহাব বা উত্তম। যদি নিজে যবাই করতে না পারেন, তবে অন্যের দ্বারা যবাই করবেন, কিন্তু নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। কুরবানিদাতা মেয়েলোক হলে পর্দার ব্যাঘাত হয় বলে যদি সামনে উপস্থিত না থাকতে পারে, তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই।
কুরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। যদি মনে মনে চিন্তা করে নিয়ত করেন এবং মুখে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে যবাই করেন তবুও কুরবানি জায়েজ হয়ে যাবে।
ছাগল, পাঁঠা, খাসী, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এ কয় প্রকার গৃহপালিত পশুকে কুরবানি করা জায়েজ আছে। গরু, মহিষ এবং উট এ তিন প্রকার পশুর এক একটিতে এক সাথে সাত জন পর্যন্ত শরীক হয়ে কুরবানি করতে পারবেন। তবে কুরবানি জায়েজ হওয়ার জন্য শর্ত এ যে, কারো অংশ যেন সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম না হয় এবং কারো যেন গোশত খাওয়ার নিয়ত না হয়। সবার যেন আল্লাহর জন্য কুরবানির নিয়ত থাকে। অবশ্য যদি কারো আকীকার নিয়ত হয়, তবে তাও কুরবানির সাথে করা জায়েজ আছে। ছাগল পূর্ণ এক বছরের কম হলে জায়েয হবে না। এক বছর পুরা হলে জায়েয হবে। গরু, মহিষ দুই বছরের কম হলে জায়েয হবে না। উট পাঁচ বছরের কম হলে জায়েয হবে না। কুরবানির পশু যবাইকারী ও গোশত প্রস্তুতকারীর শ্রমিকদের পারিশ্রমিক পৃথকভাবে দিতে হবে, কুরবানির গোশত, চামড়া, মাথা বা কোন অঙ্গ দিয়ে দিলে হবে না। তবে উক্ত কুরবানির গোশত তাদেরকে কোন বদলা ছাড়া দান করা বা দাওয়াত করে খাওয়াতে পারবেন।
কুরবানির গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের ও একভাগ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া মুস্তাহাব বা উত্তম। কুরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরীব-দুঃখী অথবা মাদরাসার এতিমদের দান করে দেয়া উত্তম।
কুরআনের আরেক জায়গায় উল্লেখ আছে, আল্লাহর নিকট পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৭)। এ আয়াত দ্বারা আমরা সহজে বুঝে নিতে পারি, কুরবানি কোন লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কুরবানিতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে তাহলে এই অর্থ ব্যয় কোন কাজে আসবে না।
আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু ক্রয় করে প্রদর্শন করা কিংবা বাহাদুরী জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরীব-মিসকিনদের যথাযথভাবে না দিয়ে ঈদের দিন নিজেরা যৎসামান্য গোশত রান্না করবে; আর বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর সারা বছর কিছু কিছু নিয়ে নিজেরা খায়। এগুলোর কোন প্রকারই প্রকৃত কুরবানির পর্যায়ে পড়ে না। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘বলো- আমার সালাত, আমার হজ্জ ও কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবাই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে।’ (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)।
অতএব লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা, বাহাদুরী জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি হবে না, বরং হালাল উপার্জন, ইখলাছ ও একনিষ্ঠতাই হলো কুরবানি কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করলো, কার পশুটি কত মোটা-তাজা বা সুন্দর, আল্লাহ তা দেখেন না। তিনি দেখেন সহীহ নিয়ত ও তাকওয়া। হাদীসের ভাষায়-ইন্নাল্লাহা লা ইয়ানযুরু ইলা ছুরাতেকুম অলাকিন ইয়ানযুরু ইলা-কুলুবেকুম ও আ’মালেকুম। আল্লাহ কারো চেহারার দিকে তাকাবেন না বরং তিনি তাকাবেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের দিকে। আল্লাহ আমাদের সকলের কুরবানি কবুল করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যাপক কবি ও প্রবন্ধকার।