আজহার মাহমুদ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা এখনো একটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। আমরা কেনো প্রযুক্তিতে উন্নত বিশ্বের সমান অগ্রসর হতে পারছি না। প্রযুক্তির যুগে বিশ্বজুড়ে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ন্যানো-প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা কিংবা বায়োটেকনোলজির মতো জটিল ক্ষেত্রগুলোতে তরুণরা দক্ষতা অর্জন করছে, সেখানে আমাদের দেশের একটি বড় অংশের শিক্ষার্থী এখনো মৌলিক প্রযুক্তি ব্যবহারে যথাযথভাবে দক্ষ হয়ে উঠেনি। এটা নিছক একাডেমিক সমস্যা নয়, এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত একটি বিষয়। ফলে এ প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে- প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ আসলে কেন পিছিয়ে?
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো সময় ও সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ মানুষ তৈরি করা। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষানির্ভর এবং মুখস্থভিত্তিক শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। বইয়ের পাতায় আটকে থাকা শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে মেলাতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। বিদ্যালয় পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তা কেবল একটি সীমিত পরিসরে, পরীক্ষার খাতায় নাম লেখানোর জন্য পড়ানো হয়। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ল্যাব নেই, থাকলেও সেগুলো সচল থাকে না। শিক্ষকরা নিজেরাই আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ নন। ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে কোনো বাস্তব অনুশীলনের সুযোগ পায় না। এর ফলে যে প্রযুক্তি শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা হয় না। আর শিক্ষার্থী যখন উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যায়, তখন তাদের সামনে হঠাৎ এক বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়, যা সে পূরণ করতে পারে না।
এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রসঙ্গ উল্লেখ করা জরুরি। বিশ্বে ইতোমধ্যেই শিক্ষা, গবেষণা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, এমনকি বিনোদনেও এআই বিপ্লব ঘটাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর স্কুল ও কলেজে এআই-সংক্রান্ত পাঠদান শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে কিভাবে এআইকে ব্যবহার করে কঠিন সমস্যাও সহজে সমাধান করা যায়। অথচ বাংলাদেশে এখনো এআই একটি দূর আকাশের তারা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমিত কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা মূলত তাত্ত্বিক জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এআই শিক্ষার কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে যখন বিশ্ব নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করছে, আমরা তখনো শিক্ষার্থীদের পুরনো পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করানোতেই ব্যস্ত রয়েছি। এ পশ্চাদপদতার কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। যে বিষয়গুলো আজকের বিশ্বে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, তা আমাদের পাঠ্যক্রমে অনুপস্থিত থাকায় শিক্ষার্থীরা অদক্ষ রয়ে যাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট শিক্ষার্থীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অন্য প্রান্তের জ্ঞান অর্জন করার জন্য ইউটিউব, কুর্সেরা, খান একাডেমি, এডএক্স বা এমআইটির অনলাইন কোর্সে ভরপুর সুযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী চাইলে নিজের ঘরে বসেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রোগ্রামিং ভাষা, কিংবা গবেষণা পদ্ধতি শিখতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও তা মূলত বিনোদননির্ভর। ফেসবুক, টিকটক বা ইউটিউবের বিনোদনমূলক কন্টেন্ট তাদের সময় নষ্ট করে, অথচ শিক্ষামূলক কন্টেন্ট ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে ওঠে না। এর পেছনে একদিকে রয়েছে প্রযুক্তিভিত্তিক সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটকে শিক্ষার কাজে ব্যবহার করতে হয়, তবে এ অপব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসত এবং তারা প্রযুক্তিকে দক্ষতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারত।
প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ার আরেকটি বড় কারণ হলো শিক্ষকদের প্রযুক্তি-দক্ষতার ঘাটতি। অধিকাংশ শিক্ষকই নিজেরা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত নন। তাদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল টুলস, এআই, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কিংবা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার খুব একটা গুরুত্ব পায় না। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই একই অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। করোনাকালে আমরা এ বাস্তবতাকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখেছি। হঠাৎ করে অনলাইনে ক্লাস চালু করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি। অথচ বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীরা তখন অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় সাবলীলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছি, প্রযুক্তি শিক্ষার অবকাঠামোগত ঘাটতির পাশাপাশি আমাদের মানসিক প্রস্তুতিরও ঘাটতি আছে।
প্রযুক্তি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানের দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ছে। আজকের বিশ্বে প্রযুক্তিভিত্তিক চাকরি সবচেয়ে বেশি তৈরি হচ্ছে- সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডাটা সায়েন্স, এআই ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি খাতে। ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের তরুণ প্রজন্মকে এসব খাতে দক্ষ করে তুলেছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল ভূমিকা রাখছে। আর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সেখানে মৌলিক কম্পিউটার দক্ষতায়ও পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনেকের ইংরেজিতে সীমিত দক্ষতা, প্রোগ্রামিংয়ে অনভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তি-ভিত্তিক গবেষণার অক্ষমতা দেখা যায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক মানের চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয়, যা দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি সংযোজন না করায় আমরা যে কতটা পিছিয়ে যাচ্ছি, তা বিশ্বের সাথে তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের শ্রেণিকক্ষগুলো স্মার্ট ক্লাসরুমে রূপান্তরিত। প্রতিটি শিক্ষার্থী ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পড়াশোনা করছে এবং বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে শিখছে। বাংলাদেশে এখনো হাজারো স্কুলে বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট সংযোগ নেই, ল্যাব নেই। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীরা কীভাবে বিশ্বমানের প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠবে?
তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে অসাধারণ মেধা আছে। আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বহুবার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে নতুন নতুন তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছে। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ মাত্র। এগুলোকে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগে রূপান্তর না করলে প্রযুক্তি শিক্ষায় অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এআই, প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সাইবার সিকিউরিটি, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান চালু করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দেয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য ইন্টারনেট ব্যবস্থা করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার শেখানো দরকার।
সবশেষে বলা যায়, প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার স্থবিরতা, অবকাঠামোর দুর্বলতা, শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনার ঘাটতি। বিশ্ব যখন দ্রুত এগোচ্ছে, তখন আমাদের এক মুহূর্ত দেরি করার সুযোগ নেই। আজ যদি আমরা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দিতেই পারি, তবে তারা শুধু দেশের জন্য নয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিতে পারবে। কিন্তু যদি আমরা এ সুযোগ হারাই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। তাই এখনই প্রযুক্তিকে শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারায় আনা এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা আমাদের অন্যতম জরুরি কাজ। আগামীর সরকার যে-ই আসুক বিষয়টি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। সে সাথে বিশ্বাস করি প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের সাথে সমানে সমান লড়াই করবে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।