খন্দকার তাওহীদ

আগের দিনে গ্রাম বাংলার উঠানজুড়ে শোনা যেত ঢেঁকির সে ছন্দময় ঠক ঠক শব্দ। একসময় ঢেঁকি ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রনির্ভরতার ভিড়ে সে ঢেঁকি আজ হারিয়ে গেছে। এখন আর ভোরে সে ছন্দময়, রূপময় ঠক ঠক শব্দ শোনা যায় না।

তবুও ঢেঁকি ছিল গ্রাম বাংলার এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এর মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলনমেলা বসতো। এ যন্ত্রটির গঠন খুব জটিল ছিল না। ঢেঁকি মূলত কাঠ দিয়ে তৈরি একটি যন্ত্র। একটি ভারী কাঠের ফালি একদিকে ভার দিয়ে বাঁধা থাকত, অন্যপাশে থাকত একটি ভারী পাথর, যা ধান পিষে চালে রূপান্তরিত করত। নারীরা এক পা দিয়ে চাপ দিয়ে এটি ওঠাতেন এবং তারপর ছেড়ে দিতেন, এভাবেই চলতো ধান ভাঙার কাজ।

ঢেঁকি বাংলার লোকসংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। নানা ধরনের গান-বাজনা, লোকগীতি, যাত্রাপালায় ঢেঁকির উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রামের কাকডাকা ভোরে গ্রামীণ নারীরা ঢেঁকি ঘরে একত্রিত হয়ে নানা ধরনের কৌতুক, গান, হাসি-ঠাট্টা আর সুখ-দুঃখের গল্পে মেতে উঠতেন। আহা! সে এক মধুর পরিবেশ ছিল! মনে হতো যেন এক আনন্দময় আড্ডার আসর। বাংলার গ্রামীণ জনপদের সকল ঘটনা এই ঢেঁকি ঘরেই আলোচনা হতো। কিন্তু আধুনিক নগরায়নের ফলে বাংলার এ স্মৃতিময় ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। এখন এ স্মৃতিময় ঢেঁকি কেবল জাদুঘরেই দেখা যায়। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা জানেই না যে, একসময় এ যন্ত্রটির মাধ্যমেই গ্রামীণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়ে উঠতো। বর্তমানে টিকটক যেমন বিনোদনের মাধ্যম, ঠিক তেমনি একটা সময় ঢেঁকির ঘর ছিল বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র।

ঢেঁকি গ্রাম বাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্যের অংশ। ঢেঁকির মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির এক প্রাণবন্ত আসর গড়ে উঠতো। কতো কথা, কতো স্মৃতি, কতো হাসি-কান্না, বেদনায় মুখর থাকতো এই ঢেঁকি ঘর! তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি অজানাই রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মকে এ স্মৃতিময় ঢেঁকির কথাগুলো জানাতে হবে। বর্তমানে ঢেঁকি যেন কেঁদে কেঁদে বলছে, “আমায় তোমরা সংরক্ষণ করো।” তাই এই ঐতিহ্যটিকে ফিরিয়ে এনে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদেরই দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।