মানিক মজুমদার
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ এবং ‘আজকের মেধাবী তরুণ আগামীতে দেশের কর্ণধর’- এ চিরন্তন সত্য কথাগুলি আমরা সবাই ছোটবেলা থেকেই কমবেশি জানি। কিন্তু যান্ত্রিক যুগে একদিকে যেমন কর্মব্যস্ততা অন্যদিকে ক্ষমতা ও স্বার্থের লড়াই মানব জাতিকে একটি মোহে আবদ্ধ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অথৈ সাগরে। যেখানে মানবতা, মনুষ্যত্ব সবকিছু বিলীন হয়ে শুধু অন্ধ মোহ নিজেকে গ্রাস করছে।
অতীতে বৃহৎ অঞ্চলে দু’একটি পাঠশালা থাকতো, সেখানে পণ্ডিত মশাই শিক্ষা দিতেন। হাতে গোনা মানুষ পুঁথিগত শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে পারতো। কিন্তু পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে যে মানবিক শিক্ষায় আলোকিত হতে পারতো সেটা তাদের জীবন ধারণের জন্য সমাজ ও দেশকে পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। ছোটরা গুরুজনকে সম্মান করতো, মানুষ হিসাবে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরকে ভালোবাসতো, মায়া মমতার বন্ধনে মিলেমিশে গ্রামে/মহল্লায় বসবাস করতো, অশিক্ষিত মানুষ হলেও মানবিক গুণে গুণান্বিত ছেলে মেয়েরা বড়দেরকে মান্য করতো, শিক্ষকদেরকে সম্মান করতো, এভাবে ধীরে-ধীরে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। শিক্ষানুরাগী মানুষ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হন। শিক্ষাদানে আগ্রহী সমাজের সচেতন মানুষগুলিও সামান্য বেতনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আন্তরিকভাবে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলী অর্জনে ব্রতী ছিলেন। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে শিক্ষাদান ও গ্রহণের একটি আন্তরিক আগ্রহ ছিল। অনেক দূরে হেঁটে গিয়ে পথের ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে তখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, শিক্ষকদেরকে ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তাদের আচার ব্যবহারে প্রমাণিত হত তারা শিক্ষিত সভ্য মানুষ।
মানবসভ্যতার বিবর্তনে আধুনিক যুগে ‘শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো’- এ শ্লোগানে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল সৃষ্টি হয়েছে, স্কুলগুলি সরকারিকরণ করে শিক্ষকদের মোটা অংকের টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নানারকম সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদান করে বিনামূল্যে বই, আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে সে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। সরকারি নিয়মে ৬ বছরের নিচে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়না। কেননা শিশুদের মেধা গঠন ও বিকাশের উপযুক্ত সময় বিজ্ঞজনদের মতে ৬ বছর। অপরদিকে অত্যাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নামে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কিন্ডার গার্টেন নামক স্কুল। কোমলমতি শিশুদের মাত্র ৩/৪ বছর পার হলেই প্লে, নার্সারী নামক শাখাগুলিতে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ভর্তি করছে। সমাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ পরিবারের ন্যূনতম সামর্থ্যবান মানুষও ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলিতে। সবারই মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার কোন মান নেই, পরিবেশ নেই। ঐ স্কুলে সন্তানকে পড়ালে তার মেধা গঠন হবে না, পরবর্তীতে কোন ভাল স্কুলেও স্থান পাবে না। নিতান্তই যাদের কোন সামর্থ্য নেই কিংবা অসহায় পরিবারের সন্তান তারাই শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ঐ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানগুলোও শতকরা ৯০/৯৫% ভাগ কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ছাত্র। তাহলে জনগণের প্রদত্ত করের টাকা দিয়ে সরকারি বেতন গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহকারী শিক্ষকদের এ প্রবঞ্চনা কার সাথে? শিক্ষাদানের আগ্রহ, একাগ্রতা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষাদানের প্রশিক্ষণ নিয়ে শিশুকিশোরদের শিক্ষাদানে অপারগতা না অনীহা! প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি যেন অসহায় দুঃস্থদের জন্য দায়সারা শিক্ষা সেবা কেন্দ্র। এর প্রতিকারে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেই যথাযথ পদক্ষেপ। বরং দেশীয় শিক্ষানীতিকে অগ্রাহ্য করে যত্রতত্র গড়ে উঠছে কিন্ডার গার্টেন স্কুল। সেখানে নেই শারীরিক শিক্ষার কিংবা জাতীয় সঙ্গীত, শপথ গ্রহণের সুযোগ। নেই খেলাধূলার পরিবেশ, শুধু বর্ণমালার বিভিন্ন রকমের বই, কয়েকটি খাতা দিয়ে, স্কুল ড্রেস, গলায় টাই ঝুলিয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের আনা নেয়া। সেখানেও স্কুল ভ্যান থেকে মাইক্রো গাড়ি পর্যন্ত আছে টাকার বিনিময়ে সেবা দিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর অধীনে জেলা/উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে। তাদের সম্মতি সাপেক্ষে প্রকাশ্যেই শিক্ষাবাণিজ্য চললেও নেই কোন পদক্ষেপ। স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে কী স্বেচ্ছাচারিতা? নাকি বৈরীতা? শিক্ষানীতি পাঠ্যপুস্তক সকল সরকারি বেসরকারি বিদ্যালয়ের এক ও অভিন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলিকে সরকারি নজরদারিতে এনে ঐসকল স্কুলের শিক্ষকদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রশিক্ষণ দিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় শিক্ষা দান করা ও শিশুদের শারীরিক ও মানসিক মেধা গঠনের তথা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ সাপেক্ষে অনুমোদন দেয়া অতীব জরুরি।
আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিনোদনমূলক আকাশ চ্যানেলগুলির সিরিয়াল নিয়মিত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ছোট বড় সর্বস্তরের মানুষকে নেশার ঘোরে ডুবিয়ে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গের মেগা সিরিয়ালগুলি। দেশের নেতাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ যাতায়াত করছেন। কেউ কি লক্ষ্য করেছেন সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা? শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল পরিবেশে মানবিকভাবে গড়ে তুলতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে দুপুরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাবার দেয়া হয়। টিফিন সময়ে ছোট থেকে বড় নিয়ম মাফিক বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র/ছাত্রী সুশৃঙ্খলভাবে থালা গ্লাস নিয়ে নির্ধিারিত জায়গায় বসে একত্রে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে নিজ-নিজ উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করে ডাস্টবিনে ফেলে হাত মুখ ধুয়ে ক্লাসে যাচ্ছে। বিকাল পর্যন্ত স্ব স্ব ক্লাস সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরছে। এর মাধ্যমে গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব, মানবতা ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন। ঘুচে যাচ্ছে ব্যবধান, ধনী-গরিবের পার্থক্য বিদ্যালয়ে নেই। যে কারণে বৃহৎ রাষ্ট্র হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড প্রভৃতি প্রদেশে ভ্রমণ করে দেখেছি ইভটিজিং, ধর্ষণ, যত্রতত্র খুন, রাহাজানি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমরা বাংলাদেশী বাঙালিরা খারাপ বিষয়গুলিকে বেশি করে আঁকড়ে ধরি। নব প্রজন্ম সুস্থ পরিবেশ না পেয়ে দিশেহারা। সমাজে যে যেমনভাবে পারছে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। শিক্ষা খাতে সরকারের প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, শিক্ষকরা সেই টাকায় সংসার পরিচালনা করলেও বাস্তবে শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে, মানবিক জ্ঞান নিয়ে প্রকৃত শিক্ষিত রূপে ক’জন আত্মপ্রকাশ করছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। শিক্ষকদের শতভাগ বেতন রাজকোষ থেকে দিতে পারলে ভবিষ্যত কর্ণধরদের দুপুরের খাবার স্কুলগুলিতে সরকারিভাবে বাবুর্চি নিয়োগ দিয়ে সকলকে একত্রে পরিবেশন করলে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ থাকবে। সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্বভাব গড়ে উঠবে, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটবে। কবি সুকান্তর কবিতা ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। দুপুরে টিফিনের পর অনেক স্কুলেই উপস্থিতি কমে যায়, থাকলেও পাঠে মনোযোগ থাকে না। সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষকবৃন্দের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রধানের কাছে জোর দাবি জানাই। বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীগুলোতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণমূলক বই সরবরাহ এবং সপ্তাহে অন্তত একদিন লাইব্রেরী ক্লাস চালু করে শিল্প সাহিত্য তথা সামাজিক ও অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। শুধু লাইব্রেরীয়ান নিয়োগ দিয়ে মাসে মাসে বেতন দিলেই শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে না, সেই সাথে প্রতিটি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তাদের নিজ নিজ স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্র/ছাত্রীদের সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। প্রজন্ম মানুষ না হলে ভবিষ্যৎ কখনোই আলোকিত হবে না একথা অনস্বীকার্য।
রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিকভাবে মানবিক শিক্ষার কোন পরিবেশ নেই। বর্তমানে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও বিনোদনের পরিবেশ ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন-পালন করতে বিদ্যালয়ে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের মাঝে বাধ্যতামূলক হিসেবে প্রচলন করতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আকাশ চ্যানেলে বিশ্ব সংস্কৃতি হাতের মুঠোয়। টিভির পর্দায় সমাজ ও মানবিক গুণকে ধ্বংসের নীল নকশা সম্পৃক্ত সিরিয়াল, অশ্লীল দৃশ্যর চোখ ঝলসানো নানা কাহিনী। বাঙালি সভ্যতা সংস্কৃতি আজ আধুনিক সভ্যতার কাছে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন মরণ নেশা প্রজন্মকে গ্রাস করেছে। ক্ষমতাসীনরা আরও অর্থ ক্ষমতা বিলাসীতায় গা ভাসিয়ে নিজেদের সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন। দেশের উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের উন্নয়ন নিয়ে প্রকৃত অর্থে মাথা ঘামানোর মানুষের আজ বড়ই অভাব। তাই বলবো সর্বাগ্রে আমাদের মানস চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে মানবিক গুণের আলো। তবেই যদি সমাজের এই অন্ধকারের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। নিজ নিজ পরিবার ও সামাজিক পরিমণ্ডলে আদি বাঙালিয়ানা প্রতিষ্ঠায় সমাজের সচেতন প্রতিটি মানুষকে সচেতনভাবে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। চিহ্নিত কুচক্রীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে তাদের অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। তাহলে সোনার বাংলা একদিন সন্ত্রাস মুক্ত, জঙ্গিবাদ মুক্ত হলেও হতে পারে। আত্মসমালোচনাই আত্মশুদ্ধির প্রকৃত পন্থা। আমরা সেই আত্মসমালোচনা ভুলে গেছি। পর নিন্দা পর সমালোচনা আজ আমাদের নিত্যকর্ম। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সিংহাসনের ক্ষমতাটা চাই’- এই নীতিতে চলছে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ক্ষমতা। সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষের মধ্যে ক্ষমতার লোভ। ধর্মীয় অনুশাসন, শুদ্ধ নীতিমালা, আত্মশুদ্ধি নেই, শুধু আত্মসুখ আর ক্ষমতার দম্ভে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিপথে চালিত করছে। যে কারণে আজ শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতা ও হতাশা বিরাজ করছে। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে অসহায়, নির্বাক। পরিশেষে সমাজে যে যেখানে যে অবস্থানে আছেন সবার প্রতি সম্মান রেখে বলবো- প্রতিটি মানুষের মাঝে একটি অন্তরাত্মা আছে। সৃষ্টিকর্তা মানুষ রূপে আপনাকে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পাঠিয়েছেন, তাঁর সফলতা দিন। কবি বলেছেন- ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর- মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেই সুরাসুর। আমরা জানি একটি মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান কথা। কিন্তু প্রতিনিয়ত স্বজন প্রিয়জনদেরকে, প্রতিবেশীকে নানাভাবে নির্যাতন করছি। আত্মীয়-স্বজনের দারিদ্র্যতার পাশে সহায় হচ্ছি না, রোগের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি না। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হজ্বব্রত পালন করছি। অর্থের দম্ভে উচ্চমূল্যের কুরবানি কিনে কুরবানির গোশত বিতরণে অনিয়ম করছি। গরিব দুঃখীর প্রাপ্য গোশত বন্ধুদের মাঝে দিচ্ছি কিংবা ফ্রিজে রাখছি। পিতা মাতাকে সেবা করা সব ধর্মের বিধান, অথচ তারা অনাদরে অবহেলায় বৃদ্ধকালে কতইনা নির্যাতন সহ্য করছে। কেউ বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাচ্ছে। হিন্দুরা পূজার নামে হাজার হাজার টাকার ফুল ফল দেবতাকে নৈবেদ্য দিচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে প্যান্ডেল করছে, প্রাচীন মূর্তিকে বিলুপ্ত করে মনগড়া বিভিন্ন মডেলের অত্যাধুনিক রূপে সজ্জিত প্রতিমা বানিয়ে চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জা করছে। পূজা ক্রমেই উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেগুলি কোন মহান কাজে লাগছে কি? পরিবেশ দূষণ/শব্দ দূষণ করে আনন্দ বিনোদনে প্রতিযোগিতামূলক আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র দিয়ে চলে পূজার উৎসব। দেবতা কতটুকু ভক্তদের অর্ঘ্য পেল সেটা মুখ্য নয়, ধর্মীয় মতে পূজা হলো কিনা সেটাও তুচ্ছ, শুধু সাজসজ্জায় অন্য ক্লাবের চেয়ে বেশি করতে পারলো কিনা সেটাই বিচার্য বিষয়।
পরিশেষে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিবেদন- অনেক ত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশে ক্ষমতার লড়াই, দলাদলি হানাহানি ভুলে যদি আমাদের পরিচয় হয় আমরা বাংলাদেশী, শান্তিপ্রিয় বাঙালি তাহলেই সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, জঙ্গিবাদ নিপাত যাবে। জেগে উঠুক মানুষের মানস চেতনা, নির্মল করো, সুন্দর করো, ঘুচাও মনের কালিমা। অন্তরাত্মা থেকে প্রত্যহ আনমনে গেয়ে উঠুন কালজয়ী সেই গানটি ‘মানুষ মানুষের জন্যে- জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি পেতে পারে না...।’ মানুষকে ভালবাসুন, অন্যকে শান্তিতে থাকতে দিন, নিজেও শান্তিতে সুখে বসবাস করুণ।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ কবিতা সংসদ।