মো. আল আমিন হোসাইন
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সংকটগুলোর একটি হলো ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। সাত দশকের বেশি সময় ধরে এ সংঘাত রক্তক্ষয়, বাস্তুচ্যুতি ও মানবিক বিপর্যয়ের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। নানা সময়ে শান্তি আলোচনার টেবিলে বসা হয়েছে, যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু সমস্যার মূল সমাধান আজও অধরা। এ অচলাবস্থার মাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সমাধানকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখে আসছে তা হলো দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বা Two-State Solution। অর্থাৎ ইসরাইল ও ফিলিস্তিন, পাশাপাশি দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সমাধান কি আদৌ বাস্তবসম্মত, নাকি কেবল কূটনৈতিক জগতে বেঁচে থাকা এক বিভ্রম?
ফিলিস্তিন ইস্যুর সূচনা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদি নিপীড়নের করুণ ইতিহাস সামনে এনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন জানায়। জাতিসংঘের প্রস্তাব ছিল দুটি রাষ্ট্র গঠন একটি ইহুদিদের জন্য, একটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। কিন্তু ইসরাইলের জন্ম হলেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। বরং প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তখন বাস্তুচ্যুত হন, যেটি ইতিহাসে নাকবা নামে পরিচিত।
এরপর একাধিক যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের অধিক ভূখণ্ড দখল করে নেয়। পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং পূর্ব জেরুজালেম ধীরে ধীরে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তি অনেককে আশাবাদী করেছিল দুটি রাষ্ট্রের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা, ইসরাইলী বসতি স্থাপন, এবং উভয় পক্ষের পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে সেই আশার মৃত্যু হয় দ্রুতই।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের মূল লক্ষ্য হলো ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। এতে পশ্চিম তীর ও গাজা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্যদিকে, ইসরাইল তার বর্তমান অবস্থানে থেকে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে।
এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। এর পেছনে যুক্তি হলো-ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা এবং ইসরাইলীদের জন্য নিরাপদ ভূখণ্ড সুনিশ্চিত করা। তত্ত্বগতভাবে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান শুনতে যতটা সহজ, বাস্তবে ততটাই জটিল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাধা এখানে কাজ করছে তা হলো: পশ্চিম তীরের বিশাল অংশে ইসরাইলী বসতি গড়ে উঠেছে। এগুলো ক্রমশ ফিলিস্তিনের সম্ভাব্য ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করছে। ফলে একীভূত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ইসরাইল জেরুজালেমকে তার ‘অখণ্ড রাজধানী’ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। এই ধর্মীয়-রাজনৈতিক ইস্যু সমাধান করাই সবচেয়ে কঠিন।
১৯৪৮ সাল থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর পুনর্বাসন বা প্রত্যাবর্তন প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। ইসরাইল তাদের ফিরে আসার অধিকার স্বীকার করে না। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভাজনও বড় বাধা। গাজায় হামাস এবং পশ্চিম তীরে ফাতাহ-দুই পক্ষের মধ্যে ঐক্যের অভাব শান্তি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো মুখে শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা বললেও বাস্তবে ইসরাইলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাধান কেবল কূটনৈতিক কাগজে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। গাজা উপত্যকা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় খোলা কারাগার হিসেবে পরিচিত। পানি, খাদ্য, ওষুধের সংকটে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। হাজার হাজার শিশু যুদ্ধ ও অবরোধের শিকার। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র ভূরাজনীতির খেলা নয়, বরং এক গভীর মানবিক ট্র্যাজেডি।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধান যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে অন্তত ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ পাবে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে এবং মৌলিক মানবাধিকার ফিরে পাবে।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধান কেবল ফিলিস্তিনিদের দাবি নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত।ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধান না হলে পুরো অঞ্চল অস্থির থাকবে, উগ্রবাদ ও সহিংসতা বাড়বে। তবে বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী নীতি, এবং আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক টানাপোড়েন এই সমাধানকে দূরবর্তী করে তুলেছে।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আজও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রীয় নীতি ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে সমর্থন করে আসছে। বাংলাদেশের মতো ছোট ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর হয়তো বড় শক্তিগুলোর মতো প্রভাবশালী নয়, কিন্তু নৈতিক অবস্থানই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান কি এখনও বাস্তবায়নযোগ্য? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইসরাইলের বসতি নীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে এ সমাধান এখন প্রায় মৃত। অন্যরা বলেন, এটিই একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ, নতুবা অঞ্চলটি ক্রমেই গৃহযুদ্ধ ও সহিংসতার গভীর খাদে তলিয়ে যাবে।
সমাধানের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী চাপ,ইসরাইলের নীতি পরিবর্তন,ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, আরব রাষ্ট্রগুলোর কার্যকর ভূমিকা
দ্বিরাষ্ট্র সমাধান একদিকে যেমন ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃতির প্রশ্ন, অন্যদিকে ইসরাইলের জন্যও একটি স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি ও শক্তির খেলায় এ সমাধান বারবার পিছিয়ে পড়ছে। যদি দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হয়, তবে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান ইতিহাসের কাগজে আটকে থাকা এক বিভ্রম হিসেবেই রয়ে যাবে। তবু মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে চাইলে, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাইলে এই সমাধানের পথেই ফিরে আসতে হবে বিশ্বকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।