জসিম উদ্দিন মনছুরি

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সময়ক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনীতির মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ত্রয়োদর সংশোধনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশনও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মাঝে ৩০টি রাজনৈতিক দল নিয়ে সংস্কার বিষয়ে কয়েক দফায় জাতীয় ঐক্যমত্র কমিশন বৈঠক করছেন। জুলাই সনদ ঘোষণার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক প্রকার সরকারের প্রতি চাপ ছিলো। অবশেষে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে জুলাই সনদ ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও বিএনপি জুলাই সনদকে পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে সন্নিবেশন করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো জুনাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলগুলোর দাবি জুলাই সনদের ভিত্তিতেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যথায় পরবর্তী সংসদে বিজয়ী দল জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে তিনটির রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে। অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অথবা সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনক্রমে অথবা গণভোটের মাধ্যমে। এছাড়া বিশিষ্ট আইনজীবী শিশির মনিরের মতে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণ ছিল বড়ই ভুল। যেহেতু গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে জনগণের অভিপ্রায়ে সুতরাং উচিত ছিল সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে গণঅভিপ্রায়ের সরকার। আইন মেনে কোন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় না সুতরাং দেশের অধিকাংশ জনগণের মত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানকে সংবিধানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। বিএনপি ছাড়া অন্যান্য দলগুলো ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে সংগঠনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। পিআর পদ্ধতিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ঘোর বিরোধিতা করছে। জামায়াতে ইসলামীসহ এনসিপি ও ইসলামি দলগুলোর দাবি পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হলে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে না। ধরা যাক কোন দল ৩১% ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৩০% ভোট। তাহলে এক পার্সেন্ট ভোট বেশি পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পরাজিত দল ৩০% ভোট পেয়েও তার ভোটের কোন মূল্যায়ন থাকেনা। পক্ষান্তরে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে সংখ্যানুপাতিক বিধায় ৩১ পারসেন্ট ভোটের যেমন মূল্যায়ন থাকে তদ্রুপ ৩০% ভোটেরও গুরুত্ব কম নয়। ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। ২০০১ সালে চার দলীয় জোট নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর চার দলীয় জোটকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি সমর্থিত জোট ১৮ দলীয় জোটে পরিণত হয়। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও গণহত্যার জন্য ইতোমধ্যে বিচার সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতি থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর ফলে দৃশ্যত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও জামায়াতে ছাড়া অন্যান্য দলগুলোর তেমন একটা ভোটব্যাংক নেই।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি’র কিছু কর্মীর ব্যাপক চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, দুর্নীতি ও হত্যার মত ব্যাপক অপকর্ম প্রকাশিত হলে জনগণ তাদের প্রতি বিমুখ হচ্ছে। তাদের মধ্যে এক প্রকার নেতৃত্ব শূন্যতাও পরিলক্ষিত। ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণ দৃশ্যত দু ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। বিএনপি’র নেতৃত্বে সমমনা জোট ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামিক জোট। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার প্রমাণ সাম্প্রতিক ডাকসু নির্বাচন ও জাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় তারই প্রমাণ বহন করে। ডাকসু ও জাকসুর নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ভোটের পরিসংখ্যানে বিএনপি’র নেতৃত্বে জোট ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলোর জোট দুই ধারায় বিভক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীর দাবি ইসলামী দলগুলো একটি ভোটবাক্সে নির্বাচন করার জন্য তারা জোটের কাছাকাছি এগিয়ে গেছেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ কওমিপন্থী পাঁচটি দল নিয়ে ইসলামী জোট গঠিত হচ্ছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। জোটের রাজনীতিতে বিএনপিও পিছিয়ে নেই। বিএনপি ছোট ছোট ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। বিএনপি বাম ঘরানার বাসস ও সিপিপিসহ ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দলকে তাদের জোটে টানার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরি মাঝে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলোর জোটের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি দীর্ঘদিনের। এবার হয়তো ইসলামী ঘরানার দলগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী নেতৃত্বে ইসলামী জোট বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী জোটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। এ দু জোটের মধ্যে কোন জোট এগিয়ে রয়েছে বলা মুশকিল। তবে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিএনপি’র কর্মকাণ্ডে জনসাধারণ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের জনপ্রিয়তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ও তাদের সাম্যের রাজনীতি জনপ্রিয়তায় শীর্ষে অবস্থান করছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের মোট ভোটারের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ভোট রয়েছে প্রায় ২৭%। অন্যদিকে বিএনপি’র ভোটব্যাংকও এর কাছাকাছি রয়েছে। আর যদি ইসলামী দলগুলোর সাথে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে জোট গঠিত হয় তাহলে ভোটের রাজনীতিতে নতুন চমক আসতেও পারে। বাংলাদেশের জনগণ ইসলাম প্রিয়। এতদিন ধরে ইসলামী দলগুলোর বিভাজনে জনগণ প্রায় রুষ্ট ছিল। যেহেতু ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে তারা চমক দেখালেও দেখাতে পারেন। সাম্প্রতিক ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

যদি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে জোট গঠিত হয় তাহলে ইসলামিক দলগুলোর বিজয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। এবার দেখার বিষয় বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামিক জোট কে কতটা ভোট টানতে পারেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দুই জোটের মধ্যে আগামী নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যেভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে তারা সরকার গঠন করলেও আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। এবার দেখার বিষয় বাংলাদেশের জনগণ ইসলামিক দলগুলোকে কিভাবে গ্রহণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৫৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামিক দলগুলোর অবস্থান ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড চোখে পড়ার মতো। এবার হয়তো জোটের রাজনীতিতে ভোটের পরিসংখ্যানে ইসলামিক দলগুলোকে অনেকে এগিয়ে রাখছেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামিক জোটের সরকার গঠিত হতে পারে। ৮৭ পার্সেন্ট মুসলিম দেশের জনগণ এখন ইসলামিক সরকারকে তাদের সরকার হিসেবে পাওয়ার অধীর আগ্রহে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণ।আশা করি জোটের রাজনীতিতে ভোটের পরিসংখ্যান ইসলামিক দলগুলোর প্রতি ঝুঁকে থাকবে। লেখক: প্রাবন্ধিক