ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ প্রাচীন রাজনৈতিক দল। দলটিকে ঐতিহ্যবাহী বলেও মনে করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার একক দাবিদার দলটি। যদিও বিষয়টি নিয়ে নানা পরিসরে ভিন্নমতও বেশ প্রবল। দলটি নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সে দাবির অসারতাই প্রমাণ হয়েছে বারবার। সংগঠনটি কখনো গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনে বিশ্বাস করেনি বরং তাদের স্বৈরতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী মানসিকতা আমাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই অনেক ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল আমরা পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারিনি।
আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দাবি করলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তার তেমন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি। উদার গণতন্ত্র, সাম্য, আইন ও সাংবিধানিক শাসন, মানবিক মূল্যবোধ ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের ক্ষমতাচর্চা ও ভিন্নমত দমনকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বানিয়েছে। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলাম তার প্রতি আওয়ামী লীগ কখনোই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি বরং স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীনরা দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলো। মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা বাদে সকল গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। সিরাজ শিকদারসহ হত্যা করা হয়েছিলো ভিন্নমতের ত্রিশ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই প্রাদেশিক পরিষদে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে। এক অনিবার্য বাস্তবতায় তারা ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা হারিয়েছিলো।
১৯৭৫ সালে ক্ষমতা হারানোর পর তারা দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে ছিলো। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে অতীত ভুলের জন্য জনগণের কাছে চেয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু অতীত স্বভাবের পরিবর্তন না হওয়ায় তারা ২০০১ সালে নির্বাচনে ক্ষমতা হারিয়েছিলো। ২০০৮ সালের সাজানো ও পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় এসে দেশ ও জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের রক্ষাকবজ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। নির্বাচন কমিশনকে দলদাস কমিশনসহ রাষ্ট্রের সকল কিছুকে করা হয় দলীয়করণ। পরিকল্পিতভাবে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হয়। তারা নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য প্রায় ১৬ বছর ধরে সারাদেশে নির্মম জুলুম ও নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। কথিত এনকাউন্টারের নামে নির্বিবাদে চালানো হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এমনকি জুলাই আন্দোলনেও চালানো হয়েছিলো নির্মম গণহত্যা।
গত বছরের আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। আওয়ামী শীর্ষ নেতাসহ অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপি এবং স্থানীয় নেতারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যারা পালাতে পারেন নি তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যরা রয়েছেন আত্মগোপনে। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতা হারানোর পর এমন গণপলায়নের ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি। ফলে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে নানা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক।
কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে এক নতুন আবহের সৃষ্টি হয়েছে। জাতি এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণার পর বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের অবস্থান জানা যাচ্ছে। গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দল আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না সেটি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা আলোচনা রয়েছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ কী ভাবছে এ নিয়ে দলের শীর্ষনেতারা মোটেই একমত হতে পারছেন না। বাংলাদেশে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ও নতুন দল গঠনের দ্বারপ্রান্তে থাকা ছাত্ররা বিভিন্ন সংস্কার করে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সুযোগ না দেয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। ছাত্র নেতাদের দাবি, জুলাই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত পতিত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করার সুযোগ যেন না দেয়া হয়। এদিকে নির্বাচনে অংশ নেয়া, না নেয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করতে মোটেই কসুর করছেন না। তারা British Broad casting Corporation (BBC)-এর কাছে অবলীলায় এসব অনুভূতির কথা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসিকে বলেছেন, তারা নির্বাচনকে স্বাগত জানায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। তবে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আব্দুর রহমান বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কার্যক্রমকে তারা বৈধতা দিচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো উৎসাহ বা উদ্বেগ কিছুই নেই আওয়ামী লীগে।
বাহাউদ্দিন নাছিম কোন প্রকার রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘নির্বাচনে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি সকল রাজনৈতিক দল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। যেখানে সুনির্দিষ্ট কাউকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে কাজ করবে না তথা সকলকে সমান অধিকার দিতে হবে। জনগণের ভোট দেয়ার অবাধ সুযোগ থাকতে হবে।’ আওয়ামী লীগের একটা ভোটব্যাংক আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ এবং সবদলের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত পরিবেশ আমরা চাই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেকোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাদের দৃঢ় সংকল্প আছে এবং সবসময়ের জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকবে’। তবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কথায় এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া, না দেয়া নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও এখনো দলটি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। অবশ্য বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, এ অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কার্যক্রমকে তারা বৈধতা দিচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো উৎসাহ বা উদ্বেগ কিছুই নেই আওয়ামী লীগে। তিনি জানান, এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন দলীয় প্রধান। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নিশ্চয় যাদের সাথে আলোচনা করা দরকার তাদের সাথে আলোচনা করেই ঠিক করবেন। তিনিই সিদ্ধান্ত জানাবেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার যে অবস্থান সে বিষয়ে মি. রহমান প্রশ্ন তুলেছেন।
তার ভাষায়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে এত ভীতি কেন? আওয়ামী লীগতো তাদের মতে ফ্যাসিবাদ, তাদের ভাষায় গণধিকৃত; বাংলাদেশের মানুষই ঠিক করবে কোন দল রাজনীতিতে থাকবে কোন দল থাকবে না। কোন দল মানুষ গ্রহণ করবে কোন দল করবে না। যারা ভোটবিহীন, মানুষবিহীন, নির্বাচনবিহীন নেতা হতে চায়, ক্ষমতা দখলে রাখতে চায় তারা আওয়ামী লীগকে ভয় পায়’। বাহাউদ্দীন নাসিম মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। আওয়ামী লীগকে যে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হবে না সেটাতো কোনো নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশের মানুষও গ্রহণ করবে না, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কারো কাছেই এটা গ্রহণযোগ্য হবে না’।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশে রাজনীতিতে রীতিমত অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান নিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও পর্যায়ক্রমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতারা ঘরছাড়া হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জেও দলটির পদধারী কোনো নেতাকে কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলীয় দিকনির্দেশনা কিংবা ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতারাও কথা বলতে রাজি হননি। একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা বলা চলে।
মূলত, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলের এ অবস্থা গোপালগঞ্জের মানুষের কাছে ‘কল্পনাকেও হার মানিয়েছে’। শুধু গোপালগঞ্জ নয় সারাদেশেই আওয়ামী লীগ নেতাদের একই রকম অবস্থা। নেতাশূন্য এ পরিস্থিতি নিয়ে দলটির আত্মগোপনে থাকা নেতারা বলছেন, মামলা, হামলা এবং নির্যাতনের কারণেই এ পরিস্থিতি। রাজনীতি এবং কর্মসূচি দূরে থাক, বাড়িতে অবস্থান করাও এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলেও আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন বলে দাবি করছেন।
গত পনের বছর কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি, নির্বাচনের নামে নির্মম প্রহসন, গুম-খুন এবং জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান যে পর্যায়ে নামিয়েছে সেখান থেকে উত্তরণ খুব সহজ নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলায় দাবি করেছেন, ভবিষ্যতে ভুল-ত্রুটি সামনে এনেই রাজনীতিতে এবং জনগণের কাছে ফিরতে চায় দলটি। তার ভাষায়, ‘আমরা যদি ভুল করি মানুষ খারাপ বললে সে সমালোচনা মেনে নিয়ে আমরা শোধরাবার চেষ্টা করবো। অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো সমৃদ্ধ কাজ করার চেষ্টা করবো। আমরা খারাপটাকে বর্জন করবো। খারাপ যদি করে থাকি সেটার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমরা দলীয় মূল্যায়ন করে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরবো। সুষ্ঠু ভোটের মধ্যে দিয়ে জনগণ যাকে চাইবে আওয়ামী লীগ মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। একটি নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে মানুষ যাদেরকে ভোট দেবে তাদেরকে মেনে নেয়ার মতো সৎসাহস আওয়ামী লীগের আছে। দেশের জনগণ, তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়েই আমরা গণ-আন্দোলন করেই এ সরকারের সকল অশুভ পরিকল্পনাকে মোকাবেলা করবো প্রতিহত করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তিনি।
অবশ্য নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের তাগাদা ও নানামুখী আলোচনার মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেড় বছরের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছেন। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে গণঅভ্যত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না; বা তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে কি না ?
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে ‘বাধা আছে, কি নেই’ সম্প্রতি এ নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য ঘিরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি কোনো বাধা দেখছেন না। জনাব মজুমদারের এ বক্তব্যের পরে তা প্রত্যাখ্যান করে ওই রাতেই বিবৃতি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে তার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো একই অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আরেকটি প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটিরও। পরে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলকে বাদ দেয়া কিংবা ভোটে সুযোগ করে দেয়ার কোনো বিষয়, এটা আমাদের প্রস্তাবের বিবেচনার মধ্যেও নেই।’
নির্বাচন সংস্কার কমিশন মনে করছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের যে আইন রয়েছে তাতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না হলে কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটি দোষী সাব্যস্ত না হলে তাদের ভোটে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ রয়েছে। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের আন্দোলনের সময় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কোনো দলের অপরাধ এখনো আমরা তদন্ত করছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কাছে যদি মনে হয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত সেটা তখন বলা যাবে।’ এ পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার কতটা সুযোগ রয়েছে সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর প্রায় ১০ মাস পরেও নিজেদের কৃতকর্মের বিষয়ে আওয়ামী লীগে কোনো অনুশোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং পুরো বিষয়টিকে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেই মনে করে দলটি। বিশেষ করে গত জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে যত প্রাণহানি হয়েছে, সেটির দায় স্বীকার করে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি দলটিকে। দলটির শীর্ষ নেতারা এখনও বিশ্বাস করেন করেন যে, গণঅভ্যুত্থানের নামে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন নেতারা। তবে এসবের মধ্যেই আগস্ট পরবর্তী সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে দলটি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
এবার আসা যাক আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়নি বরং এ ধরনের একাধিক আরো ঘটনা রয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর দলের শীর্ষনেতা সহ দলের সকল মন্ত্রী-এমপি গণপলায়নের নজীর শুধু বাংলাদেশে নয় বরং বিশ্বের আর কোথাও নেই। ১৯৯০ গণঅভ্যুত্থানের পর জেনারেল এরশাদসহ তাদের দলের নেতারা কারাবরণ করেছিলেন। দণ্ডিতও হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু তারা দেশ ছেড়ে পালান নি। এমনকি জেলে থেকেই নির্বাচন করে তারা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সম্মানজনক ৩৫ আসন লাভ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দেশে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৮০-র অধিক আসনে জয়লাভ করেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেছিলো। এরপর তাদের ওপর নেমে এসেছিলো নির্মম ক্র্যাকডাউন। কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে জামায়াত নেতাদের একের পর এক হত্যা করে দেশকে রীতিমত বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছিলো। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ মেয়াদে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু তারা কেউই দেশ ছেড়ে পালিয়ে না গিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। কখনো কখনো রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যদিও আওয়ামী আমলের সকল নির্বাচনই ছিলো তামাশা ভাঁওতাবাজী ও প্রসহনমূলক।
তবে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাসহ দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা গণহারে দেশত্যাগ বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এখন তারা আত্মগোপনে থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার চাইছেন। কিন্তু তারা যেসব সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের কথা বলে নির্বাচন করার অধিকার চাইছেন তাদের দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে বিরোধীদের জন্য সেসব অধিকার কি নিশ্চিত করেছিলেন? যদি না করে থাকেন তাহলে তারা কোন বিবেচনায় সে সুবিধা ভোগ করতে চান? বিষয়টি আত্মসচেতন মানুষের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ কি কোন গণতান্ত্রিক দল যে, তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুবিধা পাবে? উত্তর তো নেতিবাচকই হওয়ার কথা। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’ একথা তো আওয়ামী লীগের জন্য খুবই প্রযোজ্য।
মূলত, আওয়ামী লীগ নিজেরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ময়দান ছাড়া। জনগণের পাশ দাঁড়ানোর মত তাদের কোন সৎ সাহস নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষিত। তাহলে পলাতক থেকে তারা কীভাবে সে অধিকার ভোগ করবেন? কেউ নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হলে উচ্চ আদালতে আপিল করার অধিকার থাকে। কিন্তু তাকে আগে উচ্চতর আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পলাতক থেকে আপিল করার কোন সুযোগ থাকে না। তেমনি ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদেরকে জনতার আদালতে আত্মসমর্পণ করে আপীল করতে হবে। কিন্তু তারা তো সে পথ অনুসরণ করছেন না বরং তারা বৈরী রাষ্ট্রে পলাতক থেকে দেশ ও জাতিসত্ত্বাবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তাই তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুযোগ পাবেন কোন বিবেচনায়?
অবশ্য একটি পক্ষ আগামী নির্বাচনকে ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে সুযোগ দেয়ার পক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু তাদের মুখে ফ্যাসিবাদী আমলে এমন অমৃত বচন কখনো শোনা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতা হারিয়ে গণপলায়নের মাধ্যমে পতিতরা নিজেরাই আত্মাহুতি দিয়েছে। এখন যারা নির্বাচনকে ইনক্লুসিভ করার জন্য আত্মাহুতি দেয়া মৃতদেহে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে চান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য আওয়ামী লীগের অপকর্মের বিচার করা যাবে না বা জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য কি ভিআইপি নিরাপত্তা দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে? জনগণের কাছে আত্মসমর্থন করতে তাদের সমস্যা কোথায়; আর পতিত ও পলাতকদের নির্বাচন ভাবনাই বা কতখানি যৌক্তিক?