নূরুন্নাহার নীরু
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা; ইসলামী আদর্শবাহী একটি একক সংগঠন। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে আল কুরআন ও আস সুন্নাহ। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৭৮ সালের ১৫ জুলাই। তখন থেকে অদ্যবধি সংগঠনটি একই মাত্রা, একই ধারাবাহিকতায় আজও ঐতিহ্যের উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। পাশাপাশি আছে ইসলামী ছাত্রশিবির যারা শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে নিয়েই কর্মরত। অথচ কেউ কারো সাথে অংশীদারিত্বে বা পরামর্শে বা সাংগঠনিক কাঠামোতে নেই- যেমন কোন ব্যবহারিক সম্মিলনে, তেমনি নেই কোন ভাবের আদান-প্রদানেও। তবে মূল ভিত্তি ওই একই আদর্শ আল কুরআন ও আস সুন্নাহ। যেন রেল লাইনের সামান্তরাল দুটি পথ।
নারীদের এ একাকীত্ব কীর্তিময়তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে! আমি জীবনে বহু সংগঠনের সাথে জীবন কাটিয়ে আজ এ পর্যায়ে এসেছি কিন্তু কোথাও কোন নারী সংগঠনকে শুধুমাত্র নারীদের দারাই একক ভাবে চলতে দেখিনি। কোথাও না কোথাও পুরুষের উপর অবশ্যই তাকে নির্ভর করতে হয়েছে। এমনকি পুরুষকে আনন্দ দিতেও তারা অহেতুক সময় ক্ষেপণ করে হলেও পুরুষকে পাশে রেখেছে। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে আমি রেঞ্জারিং করতাম। ছাত্রীদের জন্য ছিল রেঞ্জারিং অন্যদিকে ছাত্রদের জন্য রবারস স্কাউট। কিন্তু সেখানেও আমি দেখেছি সবকিছু নারীদের দ্বারা পরিচালিত হলেও কোন একটা ক্ষেত্রে গিয়ে যেন পুরুষের শরণাপন্ন হতেই হয়েছে। এমনই সমাজে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমধর্মী নারী সংগঠন। যেখানে শুধুই নারীদের দ্বারা পরিকল্পিত, পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশিত।
এ যেন বেগম রোকেয়া রচিত সুলতানার স্বপ্নের নারীস্থানের মতই। বেগম রোকেয়া তার সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসে এক চমৎকার নারীস্থানের বর্ণনা দিয়েছিলেন, যে সমাজে নারীরাই হবে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। নারীদের দারাই পরিচালিত হবে সমাজ, রাষ্ট্র তথা যাবতীয় আদেশ, নির্দেশ, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে অগ্রগামীতা সহ থাকবে সুপ্রিম পাওয়ার ও। নারী বিদ্বেষী মনীষী শপেন হর বলেছেন, “ One need only look at a woman’s shape to discover that she is not intended for either too much mental or too much physical work. ” এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বলেছেন, “স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশত নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে; তাই বলিয়া পুরুষ প্রভু হইতে পারে না।” বেগম রোকেয়া নারীর সামাজিক জীবনের ক্রমশই ভঙ্গুরতর দিকটিতেই অধিক দৃষ্টি দিয়ে বলেছিলেন, “বাস্তবিকই নারীর অলংকার দাসত্বের নিদর্শন বৈ আর কিছু নয়”-নারীর এই আত্মিক দাসত্বের মুক্তির জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন,” অলংকারের টাকা দ্বারা স্কুলের আয়োজন করা হোক।” মূলত স্ত্রী শিক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা হলেই নারীর উন্নতি অনিবার্য হবে এবং নারীর কুসংস্কার প্রিয়তা, ফ্যাশন বিলাসিতা, আবেগ প্রবণতা দূরীভূত হয়ে সে প্রকৃতস্থ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা যেন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে সাংগঠনিক কাঠামোগত শিক্ষার মাধ্যমে। তারাও চায় নারীদের প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার। তারা চায় নারীদের পৃথক শিক্ষাঙ্গন। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
একটি মেয়ে যখন উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় পা রাখে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে, তখন তার চোখে থাকে রঙিন ঝলমলে আলো, যে আলোয় সে দিশাহারা হয়ে অনেক সময় পদস্খলনের দিকেও গড়িয়ে যায়; সেই অবস্থা থেকে তাকে টেনে তুলে এনে জীবনের সঠিক সহজ রাস্তাটি ধরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা। শুধু তাই নয় ধরিয়ে দিয়ে প্রকৃত অর্থেই একজন সত্যিকার মানুষ রুপে তাকে গড়ে তুলে। আর এর পেছনের মূল মন্ত্রই হলো আল কুরআন আস সুন্নাহ। যা আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) দেখিয়ে দিয়ে গেছেন দুনিয়াবাসীর জন্য তার নবুয়াতি জীবন দিয়ে। তারা সে পথ থেকে বিচ্যুত নয় বলেই আজও তাদের চরিত্রে কেউ কোনরকম কালেমা লেপ্টে দিতে পারেনি। বেগম রোকেয়া তার সুলতানার স্বপ্ন এর এক জায়গায় বলেছেন, “নারীগণের অসাধারণ জ্ঞান প্রতিভার বিকাশ সেই lady Land -এ কিরূপ জাজ্জল্যমান হইয়া উঠিয়াছে তাহা দেখিয়া সুলতানা নিজের আত্মার মধ্যে প্রবল উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয় অনুভব করিয়া অতিশয় উৎফুল্ল হইতেছেন।” তিনি লেডি ল্যান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে আরো বলেন, “এখানে পুলিশ নাই। সে একেবারে সত্য ও ভালবাসার রাজ্য। বস্তুত নারীজাতি সত্য ও ভালোবাসার সাক্ষাৎ প্রতিমা- স্বরূপ হইতে পারেন, যদি তাহাদের মন ও মস্তিষ্কের যাবতীয় শক্তিকে সম্পূর্ণ সুযোগ প্রদানে স্ফূর্তি লাভ করিতে দেওয়া হয়। তাহা হইলে আমাদের নারী জাতি পুরুষের পার্শ্বে নন্দনকানন ঐ লেডি ল্যান্ড এর পারিজাতে ‘বাগ’ প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে।”
মূলত লেডি ল্যান্ডের বর্ণনা দ্বারা বেগম রোকেয়া নারীদের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে অতি অসহায়া বঙ্গীয়া নারীর হৃদয়ে আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির বীজ বপন করতেই তার সুলতানার স্বপ্ন প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন। তার সে প্রতিচ্ছবি আজ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইসলামী ছাত্রী সংস্থার পরিচিতি মূলক লিফলেটটি খুললেই দেখা যাবে সুবিন্যস্ত বিশ্ব প্রকৃতির একটি মনোরম বর্ণনা কাগজের গায়ে বর্ণিত। তারপরে রয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের পরিচিতি-যার একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। তারপরেই দেখা যাবে “ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান” এর কুরানিক দলিল। এরপরে আছে মুসলমান কারা? এখানে একটি প্রশ্ন সৃষ্টি হবে হৃদয়ে। কারণ মুসলমানদের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন,”তোমরাই সর্বোত্তম জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে, অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রেখে চলবে।” সূরা আল ইমরান এর এই ১১০ আয়াতটি। এরপরেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা তাদের পরিচিতিতে তুলে ধরেছে “মানবতার বিপর্যয়” সংক্রান্ত ইতিবৃত্ত এবং “আমাদের করণীয়” বলে অত্যন্ত আবেগ তাড়িত বক্তব্যে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে ক্ষণিকের এ পৃথিবীতে আসবে শান্তি এবং পরকালের অনন্ত জীবন হয়ে উঠবে প্রশান্তিময়। এরপরেই এসেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা কি ও কেন? এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? কর্মসূচি কি? এর কার্যক্রমই বা কি? এবং সবশেষে আহ্বান।
লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে এক কথায় বলা যায় দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি হাসিল করাই জীবনের অন্যতম চাওয়া হোক। এর কর্মসূচি গুলি উল্লেখযোগ্য। যেমন এক. ছাত্রীদের মধ্যে দ্বীন ইসলামের সঠিক ধারণার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।
দুই. ইসলামপ্রিয় ছাত্রীদেরকে সুসংগঠিত করে উন্নত নৈতিক জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দান।
তিন. ছাত্রী সমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্নমুখী কি সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ।
কার্যক্রমে রয়েছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা কার্য এবং দ্বিতীয় দফায় আছে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কার্যক্রম।
সমষ্টিগত কার্যাবলী হলো :
১। ইসলামী শিক্ষার স্বপক্ষে জনমত গঠন করা, ২। ছাত্রীদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দাবি জানানো, ৩। শিক্ষা বিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি আয়োজন করা, ৪। ছাত্রীদের সামাজিক সমস্যা সমাধান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, ৫। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ৬। সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো, ৭। ক্যারিয়ার গঠন ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করা।
আমি অবাক হয়ে দেখেছি এ সবগুলো কাজেই সে ছাত্রীরাই তাদের জান-মাল দিয়ে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার প্রমাণ স্বরূপ আমি দেখেছিলাম আশির দশকে প্রথম ডাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট কালে। তারা নিজেরাই বাঁশ থেকে দড়ি কেনা পর্যন্ত, পোস্টার লাগানো থেকে ক্যাম্পিং করা পর্যন্ত- সম্পূর্ণই তাঁরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছে, কোন পুরুষের সহযোগিতা নিয়ে নয়। এ চিত্র যেন সে নারীর স্থানেরই চিত্র ছিল। ছাত্রীসংস্থা আজও সে চিত্রই বহন করে যাচ্ছে। মূলত বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন ছিল একটি ব্যাঙ্গ রসাত্মক রচনা, যেখানে নারীর স্থান নামের এক অদ্ভুত পরিকল্পনা তিনি দেখিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন “বাহু বলে নয় বরং মস্তিষ্ক বলেই পুরুষ পরাস্ত।” আমরা বলব পুরুষ অবশ্যই আমাদের পরিপূরক তবে প্রয়োজন সাপেক্ষে। সে ক্ষেত্রে যতক্ষণ একাকী একক দক্ষতায় টিকে থাকা যায়; তা নারী জাতির মেধা মননের পরিচায়ক বটে এবং নারীর আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পদক্ষেপ ও বটে। যা নারীকে অংকুর এ বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে বরং একজন পবিত্রা স্ত্রী ও মা হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
আর বাংলাদেশ ইসলামের ছাত্রীসংস্থা সে কাজটিই করে যাচ্ছে নিরলস ভাবে, বহতা নদীর মত নীরবে বয়ে। সেটি কি আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের প্রতিবিম্ব নয়।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।