মোঃ আলমগীর হোসাইন

মরহুম এডভোকেট মাওলানা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ১৯৪০ইং সালে বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বর্তমান চৌহালি উপজেলার এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০২১ইং সালের ১৫ জুলাই ৮১ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি স্কুল ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়া করেন এবং কলেজের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) ছিলেন। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বিশ্বদ্যিালয়ে স্নাতকোত্তর ও আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে ফিরে তিনি পাবনাতেই আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পাশাপশি রাজনীতিতেও সক্রিয় অংশ গ্রহণ শুরু করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিরাজগঞ্জের একটি আসন থেকে অংশ গ্রহণ করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জে এসে ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন শুরু করেন। প্রথম দিকে তমুদ্দুন একাডেমির মাধ্যমে ইসলামপ্রিয় মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ইসলামী শিক্ষার প্রসারে ইসলামিক সোসাইটি অব নারায়ণগঞ্জ-এর অধীনে আদর্শ স্কুল, নারায়ণগঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি দীর্ঘদিন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর বৃহত্তর নারায়ণগঞ্জের জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মরহুম আব্বাস আলী খান (রহ:) ও শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রহ:)-এর সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকেন। ১৯৮৮ সালে পুনরায় গ্রেফতার হওয়ার পরও দু’মাসের বেশি সময় কারাবন্দী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন (নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর থানা) থেকে এবং ১৯৯৬ সালে রাজধানীর ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলের পুরা সময়টাই তিনিসহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যগণ রাষ্ট্রীয় দমন, নিপীড়ন ও কারাভোগের স্বীকার হন। তাছাড়া গত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় তিনি ২০১৩ সালে গ্রেফতার হয়ে বয়োবৃদ্ধকালে ফের মাসাধিক কাল কারারুদ্ধ থাকেন। তিনি সুদীর্ঘকাল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে গঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় তিনি অন্যতম প্রধান আইনজীবী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এডভোকেট মাওলানা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (রহ:) সুপ্রীম কোর্টের খ্যাতিমান সিনিয়র আইনজীবী। আইন অঙ্গনে ইসলামিক আইনজীবী হিসেবে ছিলেন পরিচিত মুখ। আইনবীদদের মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তাই ইসলামী মনোভাবাপন্ন অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞরা সম্মিলিতভাবে গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল ইসলামাইজেশন অব ল’। বাংলাদেশের আইনের যতটুকু ইসলামের চিরকল্যাণকর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সেটুকুকে ইসলামী আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন “বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার”। বাংলাদেশের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি ইসলামাইজেশন অব ল’ নিয়ে কাজ করে। ইতোমধ্যে ল’ রিসার্চ সেন্টার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে।

আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর অবদান ছিলো ঈর্ষণীয়। ইসলামের অপার সৌন্দর্যকে যারা কলুষিত করতে চেয়েছিল তিনি তাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিয়েছেন, কখনো স্বপ্রণোদিত হয়ে আবার কখনো মাজলুমের পক্ষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে। বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টারের ব্যানারে তিনি মামলা লড়েছেন ফাতওয়া নিষিদ্ধকরণের বিপক্ষে। তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় মহামান্য আদালত ফাতওয়া সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রায় প্রদান করেন। অধিকার আদায় করে দেন তালাকপ্রাপ্ত নারীর খোরপোষের (হেফজুর রহমান কেইস)। আইনী লড়াই করেছেন । ‘ইউনিফাইড ম্যারেজ অ্যাক্টে’র বিরুদ্ধে। কত যে সামাজিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। ফতুয়া, খোরপোষ, তালাক শীর্ষক ইসলামী শরীআহ সংক্রান্ত মামলার সফল আইনজীবী ছিলেন তিনি।

তিনি প্রচণ্ড শিক্ষানুরাগীও ছিলেন। দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার সাথে আজীবন সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মরহুম শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আব্দুর রব (সাবেক চেয়ারম্যান, ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি), বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ.কে.এম. নাজির আহমদ, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক আব্দুল মান্নান তালিবসহ দেশ বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের সাথে কাজ করেছেন।

এডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম (রহঃ) বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতসমূহে ইসলামী ব্যাংকিং ও শরীয়াহ আইন সংক্রান্ত বিধি বিধান নিয়ে কাজ করার অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিসহ বিভিন্ন শরীয়াহভিত্তিক এবং অন্যান্য ব্যাংকসমূহের জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতসমূহে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন । ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে আইন ও বিধি প্রণয়নেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন এই ক্ষণজন্মা আইনজীবী । শুরু থেকেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির লিগ্যালেএডভাইজারের ভূমিকা পালন করেছেন এবং প্রথম দিকে তিনিসহ অনেকেই ব্যাংকের বিভিন্ন আইনী কাজে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি।

এডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম ইসলামী ব্যাংকিং ও শরীয়াহ আইন গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। তিনি সৌদি আরব, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, লন্ডন, মালয়েশিয়া, মিশর, তুরষ্ক এবং আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আল্লামা তাকী উসমানী (পাকিস্তান) ) সাইয়েদ আবুল হাসান নদভী (ভারত), ড. হাশিম জামালী (মালয়েশিয়া), ইউসুফ আল-কারযাভী (কাতার), প্রফেসর ড. সাইয়েদ আসসাফতীসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক স্কলারদের সাথে মতবিনিময় করেন।

এডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম আইন অঙ্গনে যাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুর রউফ, বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের, বিচারপতি আব্দুল কদ্দুস, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, এডভোকেট নোয়াব আলী, এডভোকেট মাহবুব উদ্দিন, এডভোকেট শেখ আনসার আলী, এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, এডভোকেট শওকত আলী প্রমুখ।

এক নজরে এডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম (রহ:) এর কর্ম ও উদ্যোগ

বাংলাদেশে ইসলামাইজেশন অব ল’ এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন।

ইসলামিক ল’ ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন।

বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি।

ইসলামী ব্যাংকের লিগ্যাল এডভাইজারের ভূমিকা পালন করেন।

ইসলামী ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় একাধিকবার নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামিক সোসাইটি অব নারায়ণগঞ্জ (আদর্শ স্কুল ও আদর্শ মহিলা মাদরাসা নারায়ণগঞ্জ) এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

তা’মিরুল মিল্লাত ট্রাস্ট ও তা’মিরুল মিল্লাত মাদরাসার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।

দারুল আমান ট্রাষ্ট, পাবনা এর ট্রাস্টি, ও দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, টংগী- এর সেক্রেটারি ছিলেন।

ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।

বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতসমূহে ইসলামী ব্যাংকিং ও শরীয়াহ আইন সংক্রান্ত অন্যতম এক্সপার্ট ছিলেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে আইন প্রণয়নের অন্যতম রূপকার ছিলেন ।

বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড (BPL এর চেয়ারম্যান ছিলেন।

ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।

ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় এডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম (রহ:) এর অবদান

অ্যাডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলাম (রহ:) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি আমৃত্যু ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি, ইসলামী আইন এবং শরীয়াহ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত ছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে

১. বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদী দূতাবাসের প্রথম রাষ্ট্রদূত শেখ ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিব (যিনি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন) এর সাথে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাগণসহ তিনি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শীতার কারণে আরবদের সাথে যোগাযোগে তিনিই মূখ্য ভূমিকা পালন করতেন।

২. ইসলামী ব্যাংকের মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল প্রণয়নের ক্ষেত্রে দেশ বিখ্যাত আইনজীবীদের সাথে তাঁর ভূমিকাও ছিল অনন্য।

৩. তিনি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের (মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্ট) মাননীয় বিচারপতিদের সাথে ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিবিধান এবং বিনিয়োগ বিতরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের agreements, contract forms, documents ইত্যাদি প্রণয়নের ব্যাপারে ব্যাংকের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মত বিনিময় করতেন এবং ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টকে এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শও দিতেন।

৪. দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখাসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মামলাগুলো উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে দক্ষতার সাথে তিনি পরিচালনা করতেন এবং ব্যাংকের একজন লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে বিভিন্ন ধরণনর আইনী সহায়তা দিতেন।

৫. তিনি একাধিকবার ব্যাংকের Annual General Meeting এ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৬. তিনি শুধু একজন আইনজীবীই নন, একজন বড় মাপের আলেমও বটে। তাই দেশবিখ্যাত আলেমদের সাথে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন ও তাতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

লেখক : সিনিয়র অফিসার, বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার।