জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের অবৈধ ও স্বৈরাচারী শাসনের পতনের ১ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেশে এখন নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। এজন্য তারা সংবিধান রক্ষার বাহানা তুলে রীতিমত অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছেন। অথচ যারা এখন সংবিধান রক্ষার জন্য মায়াকান্না শুরু করেছেন, তারা কিন্তু জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সুবিধাভোগী। কারণ, জুলাই বিপ্লবের ফলেই তাদের শীর্ষনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ফরমায়েসী ও সাজানো দণ্ডাদেশে থেকে খালাস পেয়েছেন। এমনকি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অব্যাহতি পেয়েছেন বড় বড় সাজা থেকে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান তো রীতিমত প্রাণদণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন। শুধু তাই নয় বরং বিএনপির আরো অনেক নেতাকর্মীই জুলাই বিপ্লবের কারণে কারামুক্তিসহ মামলামুক্ত হয়েছেন। কেউ আবার শিলং-এর নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরেছেন দেশে।
একথা ঠিক যে, জুলাই বিপ্লবের ফলস্বরূপ শুধু বিশেষ দলই লাভবান হয়নি বরং অন্যান্য বিরোধী দলসহ ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। প্রাণদণ্ড থেকে বেকসুর মুক্তি পেয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম। আয়না ঘরের গোপন বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আযমী ও ব্যারিস্টার আরমানসহ আরো অনেকেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ মাফিয়াতন্ত্রীদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।
বিপ্লব যেমন সংবিধান মেনে হয় না, ঠিক তেমনিভাবে স্বৈরতন্ত্রের পতনও হয় না গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এজন্য বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়। তাই এমন অনিবার্য বাস্তবতায় ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারের তখত তাউস তাসের ঘরের মত ধসে পড়েছে। অথচ এ আন্দোলনের দায় সংশ্লিষ্টরা নিতে চাননি। যার প্রমাণ মেলে বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য থেকে। তিনি জুলাই আন্দোলন চলাকালে বলেছিলেন, এ আন্দোলনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই বরং এর সাথে সরাসরি জড়িত শিক্ষার্র্থীরা। তার এ বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, তারা এ আন্দোলনের এমন সফল পরিণতির কথা কখনো ভাবতেই পারেন নি বরং তারা পতিত সরকারকে খানিকটা ‘কাতুকুতু’ দেয়ার জন্য নিরাপদ দূরত্বে থেকে পেছন থেকে আন্দোলনকে সমর্থন যুগিয়েছেন। আর কাকতালীয়ভাবে আন্দোলনে বিজয়ের পর বিজয়ীর আসন দখল করে ‘ইউরেকা’ বলে তর্জ্জনী ও মধ্যমা উচিয়ে বিজয় চিহ্ন প্রদর্শন করছেন। যা ঝড়ে বক পড়ার মাধ্যমে ফকিরের কেরামতি বৃদ্ধির সাথে তুলনীয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন অভ্যুত্থান বা বিপ্লব সাংবিধানিক বৃত্তে হয় না, যেমন হয়নি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও। আর মু্িক্তযুদ্ধ পরবর্তী যত বিপ্লব, অভ্যুত্থান বা সরকার পরিবর্তন হয়েছে যেমন, ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তন, ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখল, ১৯৯০ সালের গণঅভুত্থান, ১৯৯৬ সালের কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন, ২০০৬ সালের জরুরি সরকার-কোন ক্ষেত্রেই সংবিধান অনুসরণ করা হয়নি বরং সংবিধানের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করেই বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে ১৯৯০ সালে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি এবং জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত তথা কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে সংবিধান সংশোধন বা সংবিধানের অনুমোদন নিয়ে তাকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরৎ পাঠানো হয়েছিলো। মূলত, এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদ তথা ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কোন ক্ষেত্রেই সংবিধান কোন প্রতিবন্ধক হয়নি। কারণ, জনগণের জন্য সংবিধান, কিন্তু সংবিধানের জন্য জনগণ নয়।
বস্তুত, জুলাই বিপ্লবও সংবিধান মেনে হয়নি বরং ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশ ও জাতির এক ক্রান্তিকালে ছাত্র-জনতার মতামতের ভিত্তিতে প্রফেসর ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। যে সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ প্রণয়ন ও স্বাক্ষর এবং গণহত্যাকারীদের বিচার চলছে। কোন ক্ষেত্রে সংবিধান কোন প্রতিবন্ধক হয়নি। বস্তত কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদান বিষয়ক গণভোট নিয়ে। পক্ষবিশেষ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে সাংবিধানিক এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও তারা জুলাই সনদে ইতোমধ্যেই স্বাক্ষর করেছেন। এ সরকারের সবকিছু করার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, এমন আগামী নির্বাচনও হতে যাচ্ছে এ সরকারের অধীনেই। শুধু জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও গণভোটের ক্ষেত্রে সংবিধান প্রতিবন্ধকতার বলে নিজেরা নিজেদের আদর্শিক দেউলিয়াত্বকেই স্পষ্ট করে তুলেছেন।
সংবিধান নিয়ে মায়াকান্না আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। যতদূর মনে পড়ে এ ইস্যুতে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেওয়া শুরু করেছিলেন সাবেক স্বৈরশাসন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৩ সালে জামায়াতের তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খান দেশের নির্বাচনগুলোকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতির সামনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এরশাদ সরকার তা সংবিধানে নেই বলে শুরুতেই প্রত্যাখ্যান করে সংবিধান রক্ষার নামে নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য দীর্ঘ নয় বছর বিরোধী দলের ওপর দলন-পীড়ন চালানো হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিষের বড়ি তিনি সরকারকে গিলতে হয়েছিলো। কিন্তু ততদিনে ঝড়ে গেছে অসংখ্য তরতাজা প্রাণ।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে একই ইস্যুতে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করলে আবার সংবিধান রক্ষার জন্য আর্তনাদ-আহাজারি শুরু হয়েছিলো। যারা কেয়ারটেকার সরকারের বেনিফিসিয়ারি হিসাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তারা সংবিধান রক্ষার নামে নিজেদের জন্ম পরিচয়কেই অস্বীকার করে আত্মঘাতি অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ফলে বিরোধী দলগুলো একদফার আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়। আর এ যৌক্তিক দাবি আদায় করতেই প্রয়োজন হয় ১৯৩ দিনের হরতালের। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে অনেকটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কিন্তু সংবিধান রক্ষার কোন কসরতই কাজে আসেনি বরং শুধুমাত্র সংবিধান সংশোধনের জন্য রাষ্ট্রের প্রভূত অর্থ ব্যয় করে একটি নির্বাচন করে গণদাবি মেনে নেওয়া হয়েছিলো।
মূলত, সংবিধান লঙ্ঘন করার জন্যই ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলন, লগি-বৈঠার তাণ্ডব, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্যের মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারকে উৎখাত করে ১/১১-এর অসাংবিধানিক জরুরি সরকার গঠন করা হয়েছিলো। আর এ অবৈধ সরকার দীর্ঘ দুু’বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর যাবতীয় ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে তা সফলভাবেই বাস্তবায়ন করেছিলো। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছেই জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরাকর পদ্ধতি বাতিল করে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু বিরোধী দলগুলো বিলুপ্ত নির্দলীয় সরকার পুনর্বহালের দাবিতে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর আন্দোলন করেছে। কিন্তু সংবিধানে নেই বা সংবিধান রক্ষার ধূঁয়া তুলে বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুপ্তহত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একেবারে রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেলা হয়েছিলো। যুক্ত হয়ছিলো আয়না ঘরের নামে গোপন বন্দীশালা। হাজার হাজার মানুষ হত্যা, লাখ লাখ মামলা এবং শেষ পর্যন্ত জুলাই বিপ্লবে প্রায় দু’হাজারের মত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো কথিত সংবিধান রক্ষার নামে। মূলত, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো অবৈধ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করা। আর এজন্যই রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে রীতিমত দলীয় ইস্তেহারে পরিণত করা হয়েছিলো।
জুলাই বিপ্লবের পর দেশ যখন ইতিবাচক পরিবর্তনের মহাসড়কে তখন আবারো নতুন করে সংবিধান রক্ষার জন্য মায়াকান্ন্ াশুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ সবকিছুই করতে পারলেও সংবিধানিক আদেশ জারি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট আয়োজন করতে পারবে না, এমন নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে আগামী নির্বাচন সহ জাতিকেই অনিশ্চিত গন্তব্যের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, সংশ্লিষ্টরা দেশ ও জাতির কথা না ভেবে নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ সংবিধান কোন ঐশী গ্রন্থ নয় যে, তা পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যাবে না। স্বাধীনতার পর মাত্র ৫৪ বছরে তো রাষ্ট্রীয় সংবিধান তো ১৭ বার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই। এমনকি অতিতুচ্ছ বা ব্যক্তিগত কারণেও সংবিধানে হাত দেওয়ার ঘটনা নেহায়েত কম নয়। অথচ দেশ ও জাতিকে অনিশ্চিত গন্তব্যের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য তারা সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সহ গণভোটের বিরোধীতা শুরু করেছেন সংবিধান রক্ষার কথা বলে। যা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং অনভিপ্রেতও।
বস্তত, সংবিধান বা শাসনতন্ত্র হলো কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সংগঠনের সে সকল মৌলিক বিধানাবলী যা ওই রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সংগঠনটির পরিচালন নীতি ও আইনি ভিত্তি গঠন করে। সংবিধান সাধারণত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দলিল। কোন দেশের ক্ষেত্রে এ শব্দ সে দেশের জাতীয় সংবিধানকে বোঝায়, যা রাজনৈতিক মৌলিক নিয়ম ও সরকারের পরিকাঠামো, পদ্ধতি, ক্ষমতা ও কর্তব্যকে প্রতিস্থাপিত করে। বস্তুত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠনকাঠামো নির্ধারণকারী সর্বোচ্চ আইন। ১৯৭২ সালে গঠিত কার্যত আওয়ামী লীগের ‘এক দলীয়’ ও ‘বিতর্কিত’ সংবিধান সভা এ গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে এবং তা একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। মুজিববাদের চার নীতি, যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত, আমাদের দেশের সংবিধান নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা অতীতে ছিলো, এখনো আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। তাই কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে সর্বোপরি জনস্বার্থে বারবার সংশোধনের প্রয়োজন হয়েছে। আর এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একথা অনস্বীকার্য যে, রাষ্ট্রের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও কারণে-অকারণে আমাদের দেশের সংবিধানে বারবার ছুঁড়ি চালানো হয়েছে। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটি ছিল কথিত যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস হয়। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান চালু করা হয় এ সংশোধনীর মাধ্যমে। ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন এ সংশোধনীর মূল কথা। জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানসহ সংবিধানে এর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয়।
১৯৮১ সালের ৮ জুলাই ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থীতার বৈধতা নিশ্চিত করা হয়। ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এইচএম এরশাদের ওই সামরিক শাসনে বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি প্রদান করা। এ ছাড়াও এ সংশোধনীতে আরো অন্য বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সংবিধানের নবম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু বিধান সংযোজন করা হয়। ১৯৯০ সালের দশম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরও ১০ বছর কালের জন্য সংরক্ষণ করার বিধান করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানে এইচ এম এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে ১৯৯১ সালে ৬ আগস্ট সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান বৈধ ঘোষণা করা হয়। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্টের এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উপ-রাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫টি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। ২০১১ সালে ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতিরজনক হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়। এ সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ৭২ এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান পাস করা হয় এ সংশোধনীর মাধ্যমে। ৮ জুলাই ২০১৮ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাবসংবলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই স্বাধীনতাত্তোর কালে বার বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এমনকি অতিতুচ্ছ ও এক ব্যক্তির কারণেও সংবিধান সংশোধনের ঘটনা একেবারে কম নয়। এমনকি সংবিধান না থাকা স্বত্ত্বেও জরুরি জাতীয় প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে তা পরবর্তী সংসদে অনুমোদন করে নেওয়ার রেওয়াজ আমাদের দেশেই রয়েছে। কিন্তু প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসন থেকে মুক্তি লাভের পর দেশ ও জাতি যখন এটি পরিবর্তনের মহাসড়কে পথচলা শুরু করেছে, তখন পক্ষ বিশেষের সংবিধান রক্ষার নামে সংস্কার, জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তির জন্য গণভোটের আয়োজনের বিরোধীতা মোটেই সুবিবেচনা প্রসূত নয়।
যারা গণভোট নিয়ে সংবিধান রক্ষার জন্য মায়াকান্না করছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য সংবিধান নয় বরং অন্যকিছু বলেই প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে। কারণ, তাদের কোন কোন নেতার মুখে উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে ‘জুলাই চেপ্টার ক্লোজড’। অথচ জুলাই বিপ্লবই তাদেরকে রাজনীতিতে সঞ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। আবার বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, তারা ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করা হবে। একথার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তারা দেশে কোন পরিবর্তন চাচ্ছেন না বরং অতীতের অশুভ বৃত্তেই আটকা থাকতে চাচ্ছেন। আর গণভোটের বিরোধীতার মাধ্যমে তারা সংবিধানে বর্ণিত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। যা তাদেরকে রীতিমত গণবিচ্ছিন্নই করবে বলে তথ্যভিজ্ঞমহল মনে করছেন। তাদের সংবিধানের জন্য মায়াকান্না শ্রুতিমধুর হলেও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।