যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যুগ যুগ ধরে এ অভিশাপ কন্যার পিতাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু কলিজার টুকরা মেয়ে যৌতুক নামক ব্যাধির নিপীড়নে না ফেরার দেশে চলে গেছে। তবু যৌতুক বন্ধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না! সে প্রশ্ন সবার। কিন্তু যৌতুক প্রতিরোধে কেউ সোচ্চার হচ্ছে না। যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া অপরাধ। তারপরও যৌতুকের রমরমা বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে নারী। কিন্তু নারীবাদীদের মুখ কিংবা কলম থেকে কোন আওয়াজ উচ্চারিত হচ্ছে না। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে মাঝে মধ্যে মাঠ গরম করা হচ্ছে। ওই পর্যন্তই শেষ। অথচ যৌতুকের কারণে বহু পরিবারে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ¦লছে। কিন্তু ওইসব নারীবাদী নেত্রীদের কোন ভূমিকা চোখে পড়ছে না। অর্থের অভাবে মেয়ের বাবারা কলিজার টুকরা মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে না। মেয়েদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল দেশের নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে। কিন্তু নির্যাতনের চিত্র মোটেও বদলায়নি। যা সত্যিই দুঃখজনক। যৌতুক বন্ধে বাংলাদেশে ‘ যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- যৌতুক হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের কাছে দাবি করা অর্থসামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ। এ দাবি বিয়ের আগে, পরে বা বিয়ের সময়-যখনই হোক না কেন, তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু মুসলমানদের বিয়ের দেনমোহর যৌতুক বলে গণ্য হবে না। বিয়ের আসরে স্বেচ্ছায় কেউ উপহার প্রদান করলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
আল্লাহতায়ালা কারো উপর জুলুম করে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন- অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না (সূরা বাকারা : ১৮৮) বর্তমানে অনেক পরিবার মেয়েপক্ষের কাছে সরাসরি যৌতুক দাবি করেন না। কৌশলে মেয়ের সুখের কথা বলে টিভি, ফ্রিজ, দামি আসবাবপত্র, ফ্ল্যাট ও গাড়ি দাবি করেন। আবার কেউ কেউ ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য অর্থ কিংবা চাকুরীর জন্য অর্থ সরাসরি দাবি করেন। যৌতুকের ভয়াবহতা কত নির্মম তা কেবল ভুক্তভোগী পরিবার-ই অনুধাবন করতে পারে। অপরদিকে যৌতুকের নামে মিথ্যা মামলার ছড়াছড়ি। নিরপরাধ ভুক্তভোগী পরিবার মামলার খরচ চালাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
নারীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সরকার যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ আইনের অপব্যবহারও বাড়ছে। কেউ কেউ প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে মিথ্যা মামলা দিচ্ছেন। ফলে কিছু মানুষ মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন। অনেক সময় বিবাহ বিচ্ছেদের পর যৌতুকের মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ যৌতুকের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বিবাহ বলবৎ থাকা প্রয়োজন। বিবাহ বলবৎ না থাকলে যৌতুকের মামলা করা যায় না। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। ‘মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম জিনাল আরা বনাম শাহিদুল এবং অন্যান্য ২ এলএনজে (২০১৩) এইচসিডি ২৩৫ মামলা। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (খ) ধারার অধীনে করা হয়; অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটি করার আগে পক্ষদ্বয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে এবং বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
যৌতুক আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। নিচে কয়েকটি ঘটনা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরলাম। ‘‘স্বামীর চাহিদা মত যৌতুক দিতে না পারায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে কড়াইয়ে সয়াবিন তেল গরম করে স্ত্রীর শরীরে ঢেলে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৪ এর বিচারক মুন্সি মো.মশিউর রহমানের আদালত মিজান সরদার নামে একজনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। (সূত্র ঃ ১৩ এপ্রিল ২০২৫ প্রথম আলো)
স্বামী আসবাবপত্র ও টেলিভিশন ক্রয় করার জন্য দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু স্ত্রী দিতে পারেনি। ফলে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন অন্ত:সত্ত্বা ওই নারীকে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে। ওই ঘটনায় মামলা হয়। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় খয়েরদিরচর গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে শাওন মিয়ার সঙ্গে একই গ্রামের বকুল মিয়ার মেয়ে প্রিমা বেগমের প্রেমের সম্পর্কের জেরে দু’বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা এনে দিতে স্ত্রীকে চাপ দেন শাওন। স্ত্রীও সাধ্যমতো বাবার কাছ থেকে টাকা এনে দিতেন। কিন্তু মাসখানেক আগে শাওন শ্বশুরের কাছে টিভি, আসবাবপত্র কিনতে দেড় লাখ টাকা চান। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় শাওনের পরিবারের লোকজন রশি দিয়ে প্রিমার হাত-পা বেঁধে মারধর করেন। একপর্যায়ে শাওন লোহার একটি কাঁচি দিয়ে তাঁর পিঠে গরম ছ্যাঁকা দেন। (সূত্র : ০২ এপ্রিল ২০২৫, প্রথম আলো)
খুলনায় যৌতুকের জন্য গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। নিহত মারিয়া সুলতানা বৈশাখী নগরের মুজগুন্নী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের বিপরীতে সরদার বাড়ির মাসুম বিল্লাহর স্ত্রী। মারিয়ার বাবার বাড়ির লোকজনের অভিযোগ- যৌতুকের জন্য মারিয়াকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনার দিনই খালিশপুর থানায় মারিয়ার স্বামী মাসুম বিল্লাহ ও শাশুড়ি নুরজাহান বেগমের বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়। (সূত্র ঃ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, প্রথম আলো)
নাটোরে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে হত্যার দায়ে যুবকের মৃত্যুদণ্ড। এ মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গুরুদাসপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে শিউলি বেগমের সঙ্গে প্রতিবেশী যুবক মো. শাহজামালের প্রেমের সম্পর্ক থেকে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় ১৫ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করা হলে শিউলির বাবা জামাতা মো. শাহজামালকে ১০ হাজার টাকা দেন। বাকি ৫ হাজার টাকা দিতে না পারায় শাহজামাল ও তাঁর মা-বাবা গৃহবধূ শিউলিকে নির্যাতন করেন। একপর্যায়ে ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শিউলিকে তাঁর বাবার কাছ থেকে বাকি ৫ হাজার টাকা এনে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু শিউলি রাজি না হলে ওইদিন রাতেই তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। (সূত্র : ৩০ অক্টোবর ২০২৪, প্রথম আলো)
যৌতুকের মামলা এখন হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনি-বনা না হলে, তুচ্ছ ঘটনায় স্ত্রী সোজা আদালতে যৌতুকের মামলা ঠুকে দেন। তবে বেশির ভাগ মামলাই মিথ্যা হয়। স্ত্রীর অভিযোগ যৌতুক দিতে অস্বীকার করায় মারধর ও নির্যাতন করেছে। আবার কেউ কেউ তালাক হয়ে যাওয়ার পরও যৌতুকের মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। অথচ এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো আইনানুগ কারণ নেই জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা বা অভিযোগ করে তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ (সংশোধিত) এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু ঘটনো হয় তাহলে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর মৃত্যু ঘটনানোর চেষ্টা করা হলে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর; কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। আইনের কঠিন প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও কেন যৌতুকের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন যৌতুকের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা। যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়।