বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মাঝে মাঝেই কোন কোন পণ্যের মূল্য যুক্তিহীনভাবেই বৃদ্ধি পায়। বিক্রেতারা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য নানা অজুহাত দেখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা অর্থনীতির সাধারণ কোন সূত্র মেনে চলে না। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শর্ত পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এ নিয়ে হৈচৈ শুরু করেছিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক করা হয় তাহলে আমদানি পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। গণদুর্ভোগ বেড়ে যাবে। কিন্তু মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার পর স্থানীয় মুদ্রা টাকার তেমন একটা অবমূল্যায়ন ঘটেনি। আর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করা হলেই সব ধরনের আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে তা নয়। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী বছর জ¦ালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ১০ থেকে ১২ শতাংশ হ্রাস পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তার খুব একটা প্রভাব পড়ে না। কারণ আমদানিকারকগণ বিভিন্ন পণ্য আমদানির সময় অতিমূল্যায়ন করে থাকে। অর্থাৎ ১২ টাকার পণ্য হয়তো তারা ২০ টাকা মূল্য প্রদর্শন করে। অতিমূল্যায়িত পণ্য তারা ইচ্ছে করলেও স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে পারবে না। কারণ এটা করা হলে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট ধরা পড়ে যাবেন।

বাংলাদেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটার পেছনে আমদানি পণ্যের মূল্য খুব একটা প্রভাব ফেলে না। কারণ বাংলাদেশ তার মোট ব্যবহার্য পণ্যের ২৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে থাকে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন এবং যোগান দেয়া হয়। তাহলে বাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় কেন? বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখেছে পণ্যের স্বল্পতার কারণে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় না। বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে সরবরাহ জনিত ঘাটতি। সাপ্লাই সাইডে নানা সমস্যার কারণেই মূলত বাজারে পণ্য মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। সে সময় বিশ্ব অর্থনীতি করোনা পরবর্তী উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ছিল। অনেকটা হঠাৎ করেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

অথচ ইউক্রেন ও রাশিয়ার সে বছর স্বাভাবিক খাদ্য পণ্য উৎপাদিত হয়েছিল। রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্বের মোট দানাদার খাদ্যের ৩০ শতাংশ যোগান দিয়ে থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেল সরবরাহ বন্ধ অথবা কমিয়ে দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী জ¦ালানি তেলের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমণের ভয়ে চাল ও অন্যান্য দানাদার খাদ্য রপ্তানি করতে পারছিল না। চাল বোঝাই জাহাজ বন্দরে আটকে থাকে। ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ তার মোট চাহিদাকৃত পণ্যের ৭৫ শতাংশ নিজেরাই উৎপাদন করে কিন্তু তারপরও পণ্য মূল্যের স্ফীতি আমাদের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জরিপ পরিচালনা করেছে। তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, নিত্যপণ্যের উৎপাদনজনিত সঙ্কটের কারণে মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে না। উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে সরবরাহজনিত ঘাটতি। এ ঘাটতি আবার প্রাকৃতিক বা উৎপাদন হ্রাসজনিত কারণে সৃষ্টি হচ্ছে না। এ সঙ্কট সৃষ্টি করছে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগীরা। দেশের বাজার ব্যবস্থার উপর তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদকদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সঙ্কটের কথা বলেছে সে সম্পর্কে আমাদের জানা আছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোন উদ্যোগ সরকারি পর্যায়ে কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশে পণ্য মূল্যের অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতা থাকে। কারণ যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন তারা সব সময়ই সরকারি ছত্রছায়ায় থাকতে পছন্দ করেন। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিগণ বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকদের নিকট থেকে বখড়া নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিই সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ চেষ্টা করলেই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া যে কোনো ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা খাদ্য উৎপাদন কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়াতে পারি। কিন্তু কোনো সরকারই সেই সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগায়নি।

দেশের কৃষকরা সনাতনি কৌশলে ফসল উৎপাদন করে থাকে। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোটেও দক্ষ নন বা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তাদের নেই। দেশের সব এলাকায় একই ধরনের ফসল উৎপাদিত হয় না। কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ কিছু ফসল ভালো ফলে। কিন্তু ক্রপ জোনিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা তাদের ইচ্ছে মতো জমিতে ফসল ফলিয়ে থাকে। ক্রপ জোনিংয়ের মাধ্যমে কোন এলাকায় কী ফসল ভালো হতে পারে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন গাজিপুরে কাঁঠাল ভালো হয়। আর রংপুরে লিচু ভালো হয়। এটা যদি কৃষক জানতে না পারে তাহলে তারা কিভাবে জমির উপযুক্ততা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন করবে? পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় কোনো ফসল ফলানো হয় না। অথচ পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে তিন পার্বত্য জেলা বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এ তিন পার্বত্য জেলাকে ফল চাষের জন্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। যদি কৃষিখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায় তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিদেশ থেকে যে পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই অতিমূল্যায়ন করা হয়। কোন পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য কত তা খোঁজ নিলেই জানা সম্ভব। সরকার যদি আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হন তাহলে পণ্য আমদানিকালে অতিমূল্যায়ন প্রবণতা কমানো সম্ভব। আর সরকার যে চেষ্টা করলে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত রমযান মাসে বাজারে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কারণ পরিবহনকালে চাঁদাবাজি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো বাজারে যে সিন্ডিকেট আছে এই সত্যটিই স্বীকার করতে চান না।

বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের জরিপে উল্লেখ করেছে, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য মূলত পরিবহন সেক্টরের অব্যবস্থাপনাই দায়ী। পণ্য পরিবহন যদি সহজীকরণ করা যেতো তাহলে বাজারে স্বস্তি ফিরে আসতো। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক যে পণ্যটি হয়তো ১০ টাকা কেজি বিক্রি করেন সে পণ্যই রাজধানী বা অন্য কোনো শহরের বাজারে গেলে বারবার হাত বদলের মাধ্যমে ৫০ বা ৬০ টাকা দামে বিক্রি হয়। পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)এর মতো একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে কৃষকের নিকট থেকে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত সংগ্রহ করে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের প্রতিটি থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি মার্কেট গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রতিদিন রাজধানী ও অন্যান্য শহর থেকে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ট্রাক প্রেরণ করে এসব মার্কেট থেকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করতে হবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য এসব বাজারে নিয়ে আসবেন। তারা নির্ধারিত মূল্যে টিসিবি’র নিকট এসব পণ্য বিক্রি করে দেবেন। তারা সে পণ্য পরিবহন করে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে নিয়ে ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দেবেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো এসব বাজার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের নিকট থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারবে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তৃণমূল উৎপাদকদের নিকট থেকে পণ্য ক্রয় করা হলে রাস্তায় পরিবহনকালে চাঁদাবাজি কমে যেতে পারে। কোন পণ্য কত মূল্যে ক্রয় করা হলো এবং কত মূল্যে বিক্রি করা হবে তা দোকানে দৃশ্যমান স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখতে হবে। ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে পণ্য আটকে রাখে। এটা বন্ধ করতে হবে। কোনো পণ্য সাপ্লাই গ্রহণের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই ভোক্তাদের নিকট বিক্রির জন্য উপস্থাপন করতে হবে। কোন পণ্য যে মূল্যে ক্রয় করা হবে তার সঙ্গে বিবিধ খরচ যোগ করে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনো পণ্য যদি ক্রয় এবং বাজারজাতকরণের জন্য একজন ব্যবসায়ীকে ১০০ টাকা খরচ করতে হয়, সে পণ্যটি তিনি ভোক্তার নিকট সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের একজন বা দু’জন কর্মর্কতাকে দিয়ে বাজার মনিটরিং করে তা টেলিভিশনে ফলাও করে প্রচারের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

আমাদের দেশে তৃণমূল পর্যায়ে যারা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করেন তারা তাৎক্ষণিকভাবেই সে পণ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। উৎপাদকগণ আর্থিকভাবে দুর্বল। ফলে তারা পণ্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন না। ফসলের মৌসুমে মধ্যস্বত্বভোগীরা উৎপাদকদের নিকট থেকে স্বল্প মূল্যে পণ্য সংগ্রহ করে তা গুদামজাত করে রাখে। পরবর্তীতে উচ্চ মূল্যে তা বাজারে ছাড়া হয়। ইসলাম ধর্মে জীবিকার জন্য ব্যবসায়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। একটি হাদিসে বলা হয়েছে, একজন সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী পরকালে নবী-রসুল ও শহীদের কাতারে অবস্থান করবেন। সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হতে হলে বেশ কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের মাঝেই সততা এবং আমানতদারি নেই। ফলে তারা ভোক্তাদের জিম্মি করে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করে ফায়দা লুটে নেন। বিশ্বের অনেক দেশেই রমযান মাসে পণ্য মূল্য কমে যায়। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা রমযান মাসকেই ভোক্তাদের জিম্মি করে অর্থ লুটে নেবার তালে থাকেন।