তোফাজ্জল হোসাইন

ইসরাইলের হামলার কারণে সব চোখ এখন গাজার দিকে। পুরো বিশ্ব যখন বোমায় বিধ্বস্ত গাজার ভবনগুলোর নিচে চাপা পড়া শিশু-নারী-বৃদ্ধ-যুবকের লাশ গুণতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের আরেক অংশ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার খবর চাপা পড়ে যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে আল-আকসা মসজিদে গত পরপর পাঁচটি শুক্রবারে ফিলিস্তিনিরা জুমার নামাজ পড়তে পারেননি। শিগগিরই মুসল্লিরা সেখানে নামাজ পড়তে পারবেন, এমন আশাও নেই। ইসরাইলী দখলদার বাহিনী কোনো মুসল্লিকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ইহুদিরা প্রতিদিনই ঢুকছেন, এমনকি এ চত্বরে তাঁরা প্রার্থনাও করছেন। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন, গাজারবাসির নির্বিচার হত্যাকাণ্ড লোকচক্ষুর আড়াল করতে কি ইরানে ইসরাইলের হামলা? এদিকে আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। প্রতিশোধ হিসেবে কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইরান। ফলে কাতার ও সৌদি আরব ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের’ অভিযোগ এনে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। এখানেই শুরু হয় প্রকৃত প্রশ্ন-ইরান যখন পাল্টা জবাবে হামলা করে, তখন তা ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’, ‘সার্বভৌমত্বের হস্তক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু যখন ইসরাইল ইরানের অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটায়, সিরিয়ায় হামলা চালায়, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, তখন আন্তর্জাতিক আইন কোথায় থাকে? সার্বভৌমত্বের কথা তখন কেউ বলেন না কেন?

গাজার শিশুদের ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে মৃত্যু, তাদের মাথায় ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হয়- এগুলো কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভেতর পড়ে না? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন গাজা দখল করে নেবেন। তারপর সেখানে রিভেরা বানানো হবে। এসব পরিকল্পনা কি সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন নয়? অথচ সে সময়ে সৌদি আরব কিংবা তথাকথিত মুসলিম নেতৃত্ব কোথায় ছিল? তখন তারা চুপ, নীরব, নিস্পৃহ। তখন তাদের কণ্ঠে জোরালো কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। তারা আন্তর্জাতিক ফোরামে টু শব্দটি করেনা। যে সৌদি আরবকে মুসলিম জাতির অভিভাবক হিসেবে মনে করা হয়, তারা জোরালো অবস্থান নিলে গাজা সংকট সহ মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাগুলো এত জটিল আকার ধারণ করতো না। মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেশ তথা মুসলিম রাষ্টগুলো জোরালো ভূমিকা রাখলে গাজায় এমন লাশের সারি বিশ্বকে দেখতে হতনা, সাহস করতোনা ইসরাইলের মতো বিষফোঁড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে হামলা করার। হ্যাঁ, পারস্য তথা ইরান বিজয়ের ইতিহাস আছে। দুটি উল্লেখযোগ্য বিজয়ের ঘটনা হলো আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট কর্তৃক পারস্য জয় এবং মুসলিমদের দ্বারা পারস্য বিজয়। বিশ্লেষকদের মতে ইরানকে হারানোতো দুরের কথা ইসরাইলই ধ্বংসের ধারপ্রান্তে।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) সাবেক পরিদর্শক ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিশেষজ্ঞ রবার্ট কেলি এমন মন্তব্য করেছেন, ইরানকে ধ্বংস করা সহজ নয় এবং ধ্বংস করা সহজ নয় ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র। সম্প্রতি বিবিসি রেডিও ফাইভকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। কেলির ভাষ্য অনুযায়ী, ফরদো স্থাপনাটি একটি পাহাড়ের গভীরে নির্মিত। এটি মাটির প্রায় ৮০ মিটার বা ২৬২ ফুট নিচে অবস্থিত এবং এর চারপাশে রয়েছে শক্ত পাথর ও কংক্রিটের প্রতিরক্ষা স্তর, যা একে প্রচলিত বা উন্নতমানের ‘বাংকার বাস্টার’ বোমার আঘাত থেকেও কার্যত অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।

রবার্ট কেলি বলেন, ফরদো সম্ভবত ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক কেন্দ্র, যা ভূগর্ভস্থ অবস্থানের পাশাপাশি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামোর মাধ্যমে সুরক্ষিত। তিনি মনে করেন, এ কেন্দ্রটি যে কোনো সামরিক হামলার সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেই ডিজাইন করা হয়ছে। এ মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ইরান ও ইসরাইলীর মধ্যে একে অপরকে হামলা করছে। ইরান ধ্বংস না হওয়ার যে ৭টি কারণ :

হরমুজ প্রণালী : ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রণালিটি পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওমান ও ইরানকে সংযুক্ত করেছে। পৃথক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরানকে। হরমুজ প্রণালি উত্তর দিকে ইরানকে আর দক্ষিণ দিকে ওমানের

মুসানদাম প্রদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আলাদা করে রেখেছে। এ সামুদ্রিক পথটি আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ খনিজতেলবাহী জাহাজ যাতায়াতের এটিই একমাত্র পথ। বিশ্বব্যাপী পেট্রোলিয়াম পরিবহনে প্রণালীটির কৌশলগত গুরুত্ব অত্যধিক। জলপথটির সবচেয়ে সরু অংশের দৈর্ঘ্য ২১ মাইল এবং প্রস্থ দু’মাইল। মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে বৈশ্বিক খনিজ তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হরমুজ প্রণালি দিয় সম্পাদিত হয়। ২০১৯ সালে হরমুজ প্রণালি দিয় এক দিনে এক কোটি ৯০ লক্ষ ব্যারেল খনিজ তেল পরিবাহিত হয়। এ অঞ্চল দিয়ে তেল পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত তেলের বেশির ভাগই এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। জাপানের আমদানিকৃত তেলের তিন-চতুর্থাংশ হরমুজের ওপর দিয়ে নিয়ে যায়। আর চীনের আমদানিকৃত তেলের অর্ধেকই আসে হরমুজ প্রণালি হয়। হরমুজ দিয়ে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেলের মতো তেলজাত দ্রব্য রপ্তানি হয় থাকে। এর সঙ্গে আছে তরলীকৃত গ্যাসও। গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্লেষকরা এটিকে পৃথিবীর রক্তনালি বলে অভিহিত করেন। এ প্রণালির আশপাশের সাতটি দ্বীপ ইরানের নিয়ন্ত্রণে, যা সে দেশের অনন্য ভূ-রাজনৈতিক শক্তি। ইতোমধ্যে ইরান এ জলপথ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত পশ্চিমারা।

তিন মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থান : ইরান ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত। উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, আর দক্ষিণে পারস্য ও ওমান উপসাগর তাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সীমান্ত দেয়। এ কৌশলগত অবস্থান ইরানকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বিশেষ সুবিধায় রেখেছে। পাঁচ শতাব্দী ধরে একই সীমান্ত ধরে টিকে থাকা রাষ্ট্র হিসেবে এর স্থিতিশীলতা নজিরবিহীন।

এছাড়া দেশটির রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা। উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর এবং দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর। এ কারণে বিশ্ব মানচিত্রে টিকে থাকা সবচেয়ে পুরনো রাষ্ট্রগুলোর একটি ইরান। গত ৫০০ বছর ধরে একই সীমান্ত নিয়ে টিকে আছে দেশটি। পৃথিবীর এমন কোনো পরাশক্তি নেই, যারা ইরানকে দখল করতে চায়নি, কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়েছে।

ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তি : মুসলিম বিশ্বে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে রেঞ্জ বা আওতা সবচেয়ে বেশি- ২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। যা কেবল ইসরাইল নয়, ইউরোপের যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডও স্বীকার করে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ভাণ্ডার সবচেয়ে আধুনিক ও বিস্তৃত। এছাড়া সস্তায় অধিক কার্যকর ড্রোন বানিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ইরান। ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানি ড্রোন ব্যবহার করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে পরাশক্তি রাশিয়া।

প্রাকৃতিক দুর্গ, পাহাড় ও মরুভূমি : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রয়েছে এক অনন্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা। পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে জাগরোস পর্বতমালা, যা দেশটিকে দুর্গের মতো সুরক্ষা দেয়। এ পাহাড়গুলো এতটাই কঠিন ও দুর্গম যে, হামলার জন্য শত্রুপক্ষ সেদিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। উত্তরেও রয়েছে প্রতিরক্ষামূলক আলবোর্জ পর্বতমালা। অন্যদিকে ইরানের রয়েছে মূল্যবান খনিজ-ইউরেনিয়াম, সোনা, রূপা আর দস্তা। পাহাড় পেরিয়ে কেউ ইরানে ঢুকতে পারলেও সামনে লুত মরুভূমি, যা পৃথিবীর ভয়ানক গরম জায়গাগুলোর একটি। তাই এ অঞ্চল দিয়ে সৈন্য ও রসদ পাঠানো অসম্ভব। এতে সামরিক অভিযান চালানো অত্যন্ত কঠিন।

ভূগর্ভস্থ সম্পদের ভাণ্ডার : ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে।

বিশ্বে তেল ও গ্যাস মজুতের অন্যতম কেন্দ্র ইরান। এখানকার খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের পরিমাণ যথাক্রমে বিশ্বের মোট রিজার্ভের ১০ ও ১৫ শতাংশ। এ সম্পদ ইরানকে দেয় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অনন্য সুবিধা। বিশেষ করে তেল বহনকারী পথগুলোতে ইরানের নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিশ্ববাজারে বড় প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে দেশটি।

শক্তিশালী মিত্র, রাশিয়া ও চীন : যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ক্রমাগত ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে ইরান। ইসরাইলের সাথে সংঘাতের পর থেকেই এ দুই পরাশক্তির সমর্থন পেয়ে আসছে ইরান। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে, ইরানে হামলার হুমকি এলে রুশ গোয়েন্দা বাহিনী সহযোগিতার আশ্বাস দেয়, যা ইসরাইল ও পশ্চিমাদের জন্য মারাত্মক ভয়ের কারণ। যা ইরানকে কূটনৈতিকভাবে আরও সাহসী করে তুলেছে।

ছায়াযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও নেটওয়ার্ক : ইরানের আরেকটি বড় শক্তি তার প্রক্সি নেটওয়ার্ক, যেটাকে বলা হয় ‘ছায়াযুদ্ধ’ ‘এক্সিস অব রেজিস্টেন্স’। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান তার সমর্থিত গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে থাকে, যেমন-ফিলিস্তিনে হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায় ফাতেমিয়ুন ব্রিগেড, ইরাকে আল বদর মিলিশিয়া এবং ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহী।

এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরি করতে পারে ইরান। পারস্য থেকে আজকের ইরান, হাজার বছরের ইতিহাসে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেলেও দেশটি কারও নিয়ন্ত্রণ মানেনি কখনো। ইতিহাসের সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।