আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। মানুষের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ না হয়ে উল্টো বিলোপ হচ্ছে। দুর্বৃত্তিপনা, সহিংসতা, বিকৃত যৌনাচার, মাদক আর ইন্টারনেটের নেতিবাচক ব্যবহার সমাজব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে চলেছে। মানবিকতা, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, দয়া-মায়ার জায়গাগুলো অনৈতিকতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলিজারটুকরা সন্তানকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। পারিবারিক কলহের জেরে একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে। অথচ একজন মানুষের ভরসা ও নিরাপত্তার প্রথম আশ্রয়স্থল হলো পরিবার। সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাবে পরিবারের ভালাবাসা, নিরাপত্তা ও মমত্ববোধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে প্রিয়জনের প্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। কখনো বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, কখনো সন্তানের হাতে বাবা-মা, কখনো স্বামীর হাতে স্ত্রী, কখনো স্ত্রীর হাতে স্বামী, কখনো ভাইয়ের হাতে ভাই, কখনো চাচার হাতে ভাতিজা হত্যার ঘটনা সংবাদের খোরাক জোগাচ্ছে। এমনকি সম্পত্তি আত্মসাৎ করার লোভে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দিতে কলিজারটুকরা সন্তানকেও হত্যা করা হচ্ছে।
পৃথিবীর কোন দেশই শতভাগ অপরাধমুক্ত নয়। তবে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় একেবারে তলানীতে ঠেকেছে। অপরাধপ্রবণতা মানুষের ভেতর আগেও ছিল। কিন্তু এখন তা ভিন্ন আকারে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনের শাসন ও সুবিচারের অনুপস্থিতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নৃশংসতা যেন মানুষের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে। একটি নিষ্ঠুর ঘটনা আগের ঘটনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থলের জায়গাটিও নিরাপদ থাকছে না। সম্পত্তির লোভে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-মা স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হত্যা করেছে। ‘‘প্রসঙ্গক্রমে আরবের জাহেলি যুগে কন্যা সন্তানকে হত্যা করার ঘটনা মনে পড়ে গেল। ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে কন্যা সন্তানকে লজ্জা মনে করে হত্যা করা হত। অথচ ইসলাম কন্যা সন্তানকে দয়া, ভালোবাসা ও মর্যাদার অধিকার দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি দু কন্যা সন্তানকে ভালোভাবে লালন-পালন করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে (সহিহ মুসলিম)’’। সম্প্রতি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাগজীপাড়া এলাকায় গত ১০ মে জান্নাতি খাতুনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার সুবাদে অনেকের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। সভ্য সমাজে এরকম নিষ্ঠুর ঘটনা শুধু বেদনাদায়ক-ই নয়, উদ্বেগজনকও বটে। সেদিন রাতে জান্নাতী আহারের পর বাবা-মার পাশের রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল। বাবা-মায়ের স্নেহের পরশে যারা থাকে তাদের আবার কিসের ভয়। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পাষণ্ড বাবা-মা জান্নাতী জান্নাতী বলে স্কুল পড়ুয়া মেয়েটাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। ঘুম ঘুম চোখে জান্নাতী বাবাকে জিজ্ঞেস করছিল বাবা এত রাতে, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? বাবা-মার পাষাণ হৃদয় কোন উত্তর না দিয়ে উল্টো ধমকের সুরে জোর করে বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে কৃষি জমির দিকে নিয়ে গেল। জান্নাতী আবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা এত রাতে আমায় এখানে কেন নিয়ে এসেছো? বাবা মা কোন উত্তর না দিয়ে ধমকের সুরে চুপ থাকতে বলল। মেয়েটার চোখেমুখে তখনও ঘুম ছিল। এক পর্যায়ে পাষাণ্ড বাবা-মা জান্নাতীর হাত মুখ জাপটে ধরে মাথায় এবং শরীরে আঘাত করে তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় জান্নাতীর চাচা খলিল হক অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পুলিশ যখন মামলাটির তদন্ত গেল তখন থলের বিড়াল বেরিয়ে এল। পুলিশ জানতে পারে, জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকে হত্যা করেছে জান্নাতির বাবা জাহিদুল ইসলাম ও মামলার বাদী চাচা খলিল।
কুড়িগ্রাম সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও মামলার আইও মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তদন্ত শুরু করে মাত্র চার ঘন্টার মধ্যে আমরা নিশ্চিত হই যে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ১১ মে রাতে নিহত জান্নাতির বাবা, মা ও চাচিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যার দায় স্বীকার করেন। (সূত্র ঃ মে ১৩, ২০২৫, ডেলিস্টার) গত ২ জুন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে দুলাভাই এর ছুরিকাঘাতে মোহাম্মদ ইয়াসিন নামে এক যুবক নিহত হন। নিহতের স্ত্রী শারমিন আক্তার জানান আমার স্বামী ইয়াসিন আমার খালাতো দুলাভাই আল আমিনের কাছে ১০ হাজার টাকা পায়। ওই টাকা চাওয়ায় তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ইয়াসিনকে আল আমিন ছুরিকাঘাত করে। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। (সূত্র ঃ ২ জুন, ২০২৫, নয়াদিগন্ত) টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এক স্বামীর বিরুদ্ধে তারই স্ত্রীকে জবাই করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রীকে হত্যা করেছেন স্বামী। (সূত্র ঃ ৩০ মে ২০২৫, যুগান্তর) এরকম বহু ঘটনা আছে, যা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। উপরোক্ত ঘটনাগুলো বলে দেয় আমাদের পারিবারিক নিষ্ঠুরতা কত ভয়বাহ আকার ধারণ করেছে।
মাছের যেমন পচন ধরে মাথা থেকে তেমনিভাবে একটি জাতির পচন ধরে পরিবার ও সমাজ থেকে। হীন কোনো অপরাধ নেই যা আমাদের পারিবারিক জীবনে সংঘটিত হচ্ছে না। মাদকের টাকা না পেয়ে সন্তান খুন করছে বাবাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। পারিবারিক জীবনে মানুষ কেন হত্যার মতো জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে, কেন পশুর মতো হিংস্র ও দানব হয়ে উঠছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ পারিবারিক নিষ্ঠুরতা কোন ব্যক্তিগত বিষয় না, এটা মানবিক ও সামাজিক সংকটের উপসর্গ মাত্র। আমরা যদি এখনই তা প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যত সমাজ আরও বেশি বিষাক্ত, ভীতিকর ও অমানবিক হয়ে উঠবে। তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকবো না। পারিবারিক সহিংসতার শিকার মানুষগুলো অনেক সময় পরিবারের বদনামের ভয়ে কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা সহ্য করে। অথচ এ নীরবতা সমাজকে ক্রমে ক্রমে অসাড় ও অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ নিষ্ঠুরতার হাত থেকে পুরো সমাজ ও পরিবারকে হেফাজত করার স্বার্থে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন ও পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার বাড়াতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া কোন জাতির নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন হয় না। কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা একজন মানুষকে সত্যিকারের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ছোটবেলা থেকেই এ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কুরআন, হাদিস, ইসলামী সাহিত্য পড়ানো। বিশেষ করে রাসূলের জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী ও বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী পড়ানো প্রয়োজন। ‘‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না। (তিরমিজি)’’ পারিবারিক নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পারিবারিক জীবনের গুরুত্বের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সামাজিক জনসচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মসজিদের সম্মানিত খতিব, ইমাম, স্কুল-কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গ্রামের মান্যবর ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনীতিবিদগণ এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা করলে পারিবারিক নিষ্ঠুরতার হাত থেকে এ জাতি মুক্তি পেতে পারে! লেখক : প্রাবন্ধিক