॥ জসিম উদ্দিন মনছুরি ॥

ইসলামের সত্যিকারের অনুসারী হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বা সুন্নি মুসলমান। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বাইরের সকল ফেরকা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট। মাযহাবের ভিন্নতা থাকলেও মূলত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বা সুন্নি মুসলমানই হচ্ছে হকপন্থী। মুসলমানগণ সাধারণত চার মাযহাবে বিভক্ত: হানাফি, শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি। চার মাজহাবের অনুসারীরাই মূলত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। তারাই ইসলামের মূল ভিত্তির উপর পরিচালিত। মুসলিম হতে গেলে তাকে সাতটি বিষয়ের উপর অবশ্যই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) যে শেষ নবী এটা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। প্রিয় নবী (সা.)-এর পর আর কোন নবী আসবেন না। এটা মনে প্রাণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। অন্যতায় সে মুসলমান হতে পারে না। রাসূলে করীম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর অনেকেই নবুয়ত দাবি করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) ওফাতের পর আমলে মুসায়লামাতুল কাজ্জাব সর্বপ্রথম নবী দাবি করে। আবু বকর (রা.) মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করেন। এরপর যুগে যুগে অনেকেই ভ- নবী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে শেষ নবী হিসেবে দাবি উত্থাপন করেন। সে একজন ভ- নবী হিসেবে সকল মুসলমানের কাছে পরিচিত। যদিও তার অনুসারীরা তাকে শেষ নবী হিসেবে মনে করেন। নাউজুবিল্লাহ। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে কখনো মসিহ, কখনো ইমাম মাহদি এবং সর্বোপরি শেষ নবী হিসেবে দাবি করে আসছিলেন। বিশ্বব্যাপী গোলাম আহমদ কাদিয়ানির অনুসারী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যাও কম নয়। তথ্যমতে আনুমানিক ১৫ মিলিয়ন বা ২০ মিলিয়নের কাছাকাছি। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারীর রয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও আফ্রিকা মহাদেশে। বাংলাদেশে তার অনুসারীর সংখ্যা আনুমানিক এক লক্ষাধিক।

আহমদীয়া তথা পূর্ণরূপে আহমদিয়া মুসলিম জামাত হলো একটি ধর্মীয় পুনর্জাগরণ বা মসিহ আন্দোলন। যা ব্রিটিশ ভারতের কাদিয়ান এলাকার মির্জা গোলাম আহমদের জীবন ও শিক্ষার ভিত্তিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে উদ্ভব হয়েছিল। মির্জা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮) দাবি করেছিলেন যে আল্লাহ তাকে আখেরি জামানায় প্রতিশ্রুত ও মুসলমানদের প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসিহ (যীশু বা ঈসা) উভয় হিসেবেই প্রেরণ করেছেন। ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত করতে এবং অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের প্রতীক্ষিত পরকালতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বদের মূর্ত করতে। তারা নিজেদের ‘আহমদি’ বা ‘আহমদিয়া’ নামকরণ করলেও সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রতিষ্ঠাতার জন্মগ্রহণকারী অঞ্চলের নাম ‘কাদিয়ান’ এর নামানুসারে কাদিয়ানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাদের মতে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী নয় বরং মির্জা গোলাম আহমদ প্রেরিত হয়েছেন নবী মুহম্মদ (সা.) এর শিক্ষা পুনর্জাগরণের জন্য। এছাড়া এ সম্প্রদায়টি অনেকের কাছে ‘মির্জায়ী’ নামেও পরিচিত।

মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত, পিতার ইচ্ছানুযায়ী সিয়ালকোটে একজন ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের সঙ্গে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।

১৮৬৮ সালের পর তিনি কাদিয়ানে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক সম্পত্তির তদারকি শুরু করেন। তবে তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্ন ও আত্মমগ্ন প্রকৃতির। অধিকাংশ সময় কাটাতেন মসজিদে নামাজ ও ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে। পরবর্তী সময়ে তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং বিশেষ করে বাটালা শহরে তারা যেসব বিতর্ক করতেন, তাতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৮৮৬ সালে, আর্য সমাজ-এর কিছু নেতা তার সঙ্গে ইসলাম সম্পর্কে সত্যতা নিয়ে বিতর্কে বসেন এবং একটি ঈশ্বরপ্রদত্ত নিদর্শন দাবি করেন। এ জন্য মির্জা গোলাম আহমদ হোশিয়ারপুর শহরে যান, এবং দাবি করেন যে তিনি ঈশ্বরের নির্দেশে সেখানে গেছেন।সেখানে তিনি ৪০ দিনব্যাপী একাকী সাধনা (চিল্লা-নশিনি) গ্রহণ করেন। তিনি তার তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে এক অনুসারীর ছোট একটি দু’তলা বাড়িতে অবস্থান নেন। তার জন্য খাবার দেওয়া হতো, তবে কেউ কথা বলত না। তিনি শুধু শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ার জন্য একটি পরিত্যক্ত মসজিদে যেতেন। মূলত এর পর থেকেই তিনি নিজেকে নবী দাবি করে আসছেন। আহমদিরা বিশ্বাস করে যে মির্জা গোলাম আহমদ ইসলামকে তার আসল প্রথমযুগীয় অবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কেতাবে উল্লেখিত যীশু বা ঈসার গুণবিশিষ্ট ইমাম মাহদী হয়ে এসেছেন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে।এর নৈতিক ব্যবস্থা চলমান করতে। তারা আরও বিশ্বাস করে যে মির্জা গোলাম আহমদ ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রদর্শিত পথে পাঠানো একজন “উম্মতি নবী”।

তাদের মতে নবুয়াত খাতামান্নাবিঈন এর অর্থ নবুয়াত এর সমাপ্তি নয় বরং খাতামান্নাবিঈন মানে “নবীগণের মোহর” বা নবীগণের সত্যায়নকারী। তাদের মতে নবী মুহাম্মদ সা. এর প্রকৃত অনুসরণে নতুন নবী আসতে পারবেন তবে তিনি হবেন ‘উম্মতি নবী’ ও তিনি কোনো নতুন শরীয়ত আনবেন না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বা সুন্নিদের মতে, এই ‘উম্মতি নবীর’ ধারণা কুরআন ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয় এবং তারা তাদেরকে ইসলামের অন্তর্ভুক্তও মানেন না। আহমদিয়াদের মতে যেহেতু তারা কালিমা তৈয়বা ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বলে তাদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই।দাবি করা হয়, মির্জা গোলাম আহমদ একসময় নিজেকে অন্য নবীদের মতই নবী দাবি করেছিলেন যা সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সূরা আন-নিসার ১৫৭-১৫৮ আয়াত অনুসারে, ইসলামের নবী হযরত ঈসা (আ.)-কে হত্যা করা হয় নি বরং আল্লাহ্ তাকে তার কাছে তুলে নিয়েছেন।

সূরা আন-নিসার সে আয়াত দু’টি হল: আয়াত ১৫৭: “আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসিহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলিতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুত তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।” আয়াত ১৫৮: “বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”হাদিস অনুসারে নবী ঈসা (আ.) আসমান থেকে সরাসরি দামেস্কের পূর্ব দিকে মসজিদের সাদা মিনারের পাশে অবতরণ করবেন। তিনি এসে আল-মাহদির (যিনি ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মেয়ে ফাতিমা (রা.)-এর বংশের হবেন) নেতৃত্বে সালাত আদায় করবেন।

তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর নিধন করবেন, জিযিয়া রহিত করবেন। ইমাম মাহদি ও মসিহ দু’জন আলাদা ব্যক্তি হবেন। এই বিষয়গুলো মির্জা গোলাম আহমদের দাবির বিপরীত হওয়ায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত আহমদিয়াদের অমুসলিম (কাফের) বলে গণ্য করেন। কেননা মুসলিম হতে হলে সর্বপ্রথম কুরআনের প্রতিটি বাক্যে বিশ্বাস রাখতে হবে। কিন্তু তারা সূরা আন-নিসার ১৫৭-১৫৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ঈসা (আ.) কে আকাশে তুলে নেয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে ইমাম মাহদী এবং মসিহ ভিন্ন ব্যক্তি হবেন, সেটাও বিশ্বাস করে না। সেজন্য তারা ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী কাফের হবে বলে বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম তাদেরকে কাফের বলে ফতওয়া দিয়েছেন।

সর্বোপরি, রাবেতা আলমে ইসলামি (মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ):১৯৭৪ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৪৪টি ইসলামি সংগঠনের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেন- কাদিয়ানি বা আহমদিয়া মতবাদ ইসলামের গ-ির বাইরে; তাদের অনুসারীরা ধর্মত্যাগী। এ বিভ্রান্ত মতবাদের প্রতিরোধ করা বিশ্বমুসলিম সমাজের দায়িত্ব। ২. ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি):১৯৮৫ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি ফিকহ একাডেমির অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়- মির্জা গোলাম আহমদের নবুওয়ত দাবি ইসলামের দৃষ্টিতে স্পষ্ট কুফরি। তাই কাদিয়ানিরা মুরতাদ ও অমুসলিম। ৩. ওআইসি বাগদাদ সম্মেলন (১৯৮৯):

এ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী এম. নাজিম উদ্দিন আল আজাদ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। ৪. ভাওয়ালপুর হাইকোর্টের রায় (১৯৩৫):বৃটিশ ভারতের ভাওয়ালপুর আদালত দীর্ঘ দশ বছর শুনানির পর রায় দেয়- কাদিয়ানিরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত ও কাফের। ৫. পাকিস্তানের বিভিন্ন আদালতের রায়:১৯৮১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত লাহোর, কোয়েটা ও সুপ্রিম কোর্টসহ একাধিক আদালত কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করে রায় দেন। ৬. বাংলাদেশ হাইকোর্টের রায় (১৯৮৬ ও ১৯৯৩):বাংলাদেশের হাইকোর্ট দু’দফায় কাদিয়ানিদের অমুসলিম হিসেবে উল্লেখ করে এবং শেষনবীর পরে নবুওয়াত দাবিকে কুফরি মতবাদ বলে রায় প্রদান করে। ৭. পাকিস্তান জাতীয় সংসদের রায় (১৯৭৪):

বত্রিশ দিনব্যাপী শুনানির পর পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে কাদিয়ানিদের সংখ্যালঘু অমুসলিম ঘোষণা করে। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক আইন করে তাদের ইসলামি পরিভাষা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইসলামি স্কলার জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে বই লিখে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত হন।

পৃথিবীর ২১৩ দেশে আহমদিয়াদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ সংগঠনের বর্তমান কেন্দ্র লন্ডনে অবস্থিত। গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা খিলাফত প্রবর্তন করে এবং তাদের নির্বাচিত ৫ম খলিফা মির্জা মাসরুর আহমেদ লন্ডন থেকে এ সংগঠনের কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। আহমদি বিশ্বাস ও কর্মকা-কে ‘আহ্মদিয়াত’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৮৮৯ সালে পাঞ্জাব অঞ্চলে আহমদিয়া আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা হলেও ‘আহমদিয়া’ নামটি রাখা হয় তারও এক দশক পর। ১৯০০ সালের ৪ নভেম্বর একটি ইস্তেহারে গোলাম আহমদের ভাষ্যে নামটি নিজের নাম ‘আহমদ’-কে ইঙ্গিত করছে। ‘আহমদ’ নামটি নবীজির মক্কী জীবনকালে তার খোতবার সৌন্দর্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ এবং উদ্যম ও ধৈর্য বহন করে এবং ‘মুহাম্মদ’ ও ‘আহমদ’-এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বেশি মনোযোগ দখল করে। উপরন্তু তিনি বলেন বাইবেলের পুরাতন নিয়মে মোশির (নবী মুসার) মত নবী বলে নবী মুহাম্মদের আগমনের উল্লেখ আছে এবং কুরআনে নবী ঈসা সে নবীর ব্যাপারে ইঙ্গিত করেন ‘আহমদ’ নামটি দ্বারা। তাই ‘মুহাম্মদ’ নামটিকে নবী মুসার জুলুমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামী কর্মকাণ্ড এবং ‘আহমদ’-কে নবী ঈসার শান্তিপূর্ণ ধর্মোপদেশ কার্যের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন এবং মুসলিম বিশ্বে অন্যান্য আন্দোলন থেকে আলাদা করতে তিনি ‘আহমদিয়া’ নামটি বেছে নেনঃ”যে নামটি এই আন্দোলনের সবচেয়ে উপযোগী এবং আমার ও আমার জামাতের জন্যে আমি পছন্দ করি তা হল ‘আহমদিয়া বর্গের মুসলমানগণ’। তবে এটি ‘আহমদি মাজহাবের মুসলমানগণ’ হিসেবে উল্লেখ হলেও তা গ্রহণযোগ্য।” (মাজমু’আ ইশ্তেহারাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৪)

২৩ মার্চ ১৮৮৯ তারিখে পঞ্জাবের লুধিয়ানায় তার বাড়িতে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি তার সহচর ও অনুসারীদের কাছ থেকে (মুসলমানদের নেতা মাহদী হিসেবে) ইমামত বা খেলাফতের বায়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করান। এর পূর্ব তিনি সূত্র অনুযায়ী তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওহী বা আপ্তবাক্য পেতে শুরু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তিনি নিজেকে মোজাদ্দেদ (মুসলিম বিশ্বে প্রতি একশত বছর পর আগত ইসলামের পুনরুদ্ধারকারী), রূপক অর্থে মসিহের পুনরাগমণ এবং মুসলমানদের প্রতীক্ষিত মাহদী হিসেবে দাবি করেন এবং ব্রিটিশ ভারতের যুক্তপ্রদেশ (বর্তমানে উত্তরাখণ্ড ও উত্তর প্রদেশ), পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী লাভ করেন। তিনি ও তার অনুসারীরা দাবি করে যে নবী মুহাম্মদসহ বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তার আগমনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছে। ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে ব্যাপক খ্রিষ্টান ও আর্য সমাজবাদী ধর্মপ্রচারের জবাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত একটি আন্দোলন হিসেবেই গড়ে ওঠে আহমদিয়া। কিন্তু পরবর্তীতে এটি ইংরেজ সরকারের পক্ষে অনেক গ্রন্থ রচনা করে এবং জিহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯১৩ সনের দিকে আহমদিয়া জামাত বিদেশে তাদের প্রচার কর্ম শুরু করে (যেমন লন্ডনে ফজল মসজিদ নির্মাণ)। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে আহমদিয়া আমেরিকায় ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ বা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত। এটি ১৯৫০ পর্যন্ত “আফ্রিকান-আমেরিকান ইসলামে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্প্রদায়” হিসেবে বিবেচিত এবং বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশে বিপুল সংখ্যক একটি ধর্মমত।

আহমদিয়া মুসলিম জামা’ত বা কাদিয়ানীদের বাংলাদেশে স্থানীয় ১০৩টি শাখা রয়েছে এবং শহরে ও গ্রামে ৪২৫ টি শাখা। সেখানে ৬৫ জন মোবাল্লেগ, একটি এম,টি,এ (মুসলিম টেলিভিশন আহমদিয়া) স্টুডিও এবং একটি জামেয়া আহমদিয়া (মোবাল্লেগ প্রশিক্ষণ কলেজ) রয়েছে ঢাকায়। মহারাজপুর মসজিদ, নাটোর। আহমদিয়া মসজিদ, খুলনা।গালিম গাজী মসজিদ, খুলনা। মসজিদে বাইতুল বাসেত, চট্টগ্রাম।

মুসলমানদের প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে আহমদিদের মতবাদের ভিন্নতা থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূলধারার মুসলমানগণ প্রথম থেকেই আহমদিয়ার বিরোধিতা করে আসছে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান সরকার আহমদিদের অমুসলিম ঘোষণা করে। পাকিস্তানের মত বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে আহমদিদের অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছে। ২০০০ সালে মালেয়শিয়া সরকার আহমদিদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে এবং আহমদি মতবাদকে ভিন্ন ধর্ম বলে ঘোষণা দিয়েছে। “Qadiani Bukan Agama Islam” সাইনবোর্ডে লিখা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সরকার আহমদি মতবাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আহমদিদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।পুরো সৌদি আরবে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের কেউ সেখানে গোপনে হজ পালন করতে গেলে তাকে আটক করা হয়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পরেও বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কাদিয়ানিদের সংখ্যালঘু বা অমুসলিম ঘোষণা করা হয়নি। সর্বশেষ ১৫ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে তেহেরিকে খতমে নবুওয়াতের ব্যানারে বিশাল গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। গণজমায়েতে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানানো হয়। গণজমায়েতে সর্বস্তরের মুসলমানগণ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা রফিকুল ইসলাম ঘোষণা করেন আগামীতে জামায়াত ক্ষমতায় গেলে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করবেন। চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিমও বলেন, তারা আগামীতে সরকারে গেলে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সংসদে আলোচনা করে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান। বাংলাদেশের মুসলমানদের গণদাবি, পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশের মত বাংলাদেশেও কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করে সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হোক। ইসলামের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাতে ইসলামের ব্যানারে মুসলিম হিসেবে অন্যায়, গর্হিত ও কুফরি কাজ করতে না পারে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশের মত বাংলাদেশের মুসলমানদেরও গণদাবিতে পরিণত হয়েছে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করা। আশা করি রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করা হবে। সরকারে যারাই আসুক না কেন? মুসলমানদের গণদাবি হচ্ছে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ও সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা করা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক