আসিফ আরসালান
গত ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। শেখ হাসিনার ‘প্রথম মামলার রায় কবে’ জানা যাবে সেটি ঘোষণার দিন ছিল ওই দিন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল যাতে করে রায়ের তারিখ ঘোষণা করতে না পারেন সেজন্য বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। দিল্লির পক্ষপুটে আশ্রয় নেওয়া পলাতক নেতা শেখ হাসিনা সে করোনার দিনগুলোর একটি মেডিকেল পরিভাষা ব্যবহার করে দিনটিকে অস্থির করতে চেয়েছিলেন। ওই পরিভাষাটি হলো, ‘লক ডাউন’। সারাদেশ, বিশেষ করে ঢাকাকে লক ডাউন করার নির্দেশ ছিল শেখ হাসিনার। ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দেখা গেল, আওয়ামী লীগ ঢাকাকে লক ডাউন করতে পারেনি। উল্টা যেসব ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী ঢাকায় এসেছিল তারাই লকড ডাউন হয়ে গেছে। এসম্পর্কে আরো কিছু কথা পরে বলবো। কারণ আইসিটি ঘোষণা করেছে যে আগামী ১৭ নভেম্বর সোমবার শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষনা করা হবে। বলা বাহুল্য, ঐ দিবসকে কেন্দ্র করে ভারতের নির্দেশে যে আরো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মসূচি দেবে তারা সেব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এসম্পর্কে শেষের দিকে আরো আলোচনা করবো।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, একদিন আগে অর্থাৎ ১২ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যার পর রাতে অকস্মাৎ ঘোষণা করা হয় যে, পরদিন অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেবেন। তখনই সমস্ত সচেতন জনতা বিলক্ষণ বুঝে যান যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে একদিকে জামায়াতের নেতৃত্বে ৮ দল এবং অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে গণতন্ত্র মঞ্চ, সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট মুখোমুখি অবস্থানের ফলে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সে সঙ্কট উত্তরণের পথনির্দেশ হয়তো প্রধান উপদেষ্টার ভাষনে থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টা ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার যথারীতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। তার ভাষনের প্রধান পয়েন্টগুলো কী থাকবে সেসম্পর্কে ১১ নভেম্বর থেকে গণমাধ্যমসমূহ স্পষ্ট পূর্বাভাস দিচ্ছিলো। বাস্তবে দেখা গেল, গণমাধ্যম সমূহের ঐসব পূর্বাভাস সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবে বাস্তব ব্যাপার হলো এ যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ বিএনপি এবং জামায়াত, ২ প্রধান দলের কাউকেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এ ২ দল ছাড়াও জুলাই বিপ্লবের নায়কদের সৃষ্ট দল এনসিপিকেও এই ভাষন সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
আসলে ৩টি বিষয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের (সংবিধান সংস্কার) পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। এগুলো হলো, ঐ বাস্তবায়ন আদেশ কে স্বাক্ষর করবেন বা জারি করবেন? প্রেসিডেন্ট? নাকি প্রধান উপদেষ্টা? এব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী ও ৮ দল এবং এনসিপির দাবি ছিল, প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরে ঐ বাস্তবায়ন আদেশ জারি হবে। তাদের যুুক্তি ছিল, জুলাই সনদের স্পিরিট ছিল জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার উপদেষ্টা পরিষদ জুলাই বিপ্লবের ফসল। আর প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার প্রোডাক্ট। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের দুঃশাসন এবং ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারকে হটানোর জন্যই জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। যেহেতু প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনা তথা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনার প্রোডাক্ট তাই তার স্বাক্ষরে জুলাই সনদের মতো বিপ্লবের সনদ জারি হতে পারে না। দ্বিতীয় ইস্যু ছিল, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের অধীনে একটি অধ্যাদেশ থাকবে যে অধ্যাদেশ বলে জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। যে পয়েন্টটি নিয়ে বিরোধ ছিল সেটি হলো, দেশের সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে না গণভোট আগে অনুষ্ঠিত হবে? নাকি ইলেকশনের দিন একই সাথে গনভোট এবং ইলেকশন দুটিই অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় ইস্যু ছিল, জুলাই সনদে ৪৮টি সুপারিশের ওপর নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি ছিল। বাস্তবায়ন আদেশে ঐ ৪৮টি আপত্তি বাদ দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২.৩০ টায় প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দিয়েছেন। সন্ধ্যার পর ৪ নেতার প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। ৪ নেতা হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের নায়েবে আমীর ড. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, সাবেক এমপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জাা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সেমিনারে বক্তব্য দানের সময় তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, চাপিয়ে দেয়া বিষয় জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্য হবে সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, পিআর পদ্ধতি এখন পর্যন্ত জনগণের নিকট বোধগম্য নয়। অথচ সেটি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো।
৯ মাস ধরে ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনার সময় বিএনপি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। নিজ বাস ভবন থেকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন প্রসঙ্গে এ নেতা প্রথমেই প্রেসিডেন্টের আদেশ জারির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, সংবিধানে প্রেসিডেন্টের অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আদেশ জারির কোনো ক্ষমতা নেই। তার মতে প্রেসিডেন্ট যে অর্ডার জারি করলেন সেটি একটি ইতিহাস। এ অর্ডার কি আইনী বৈধতা পাবে? সেটা অবশ্য বলতে পারে জুডিশিয়ারি বা বিচার বিভাগ।
সালাহ উদ্দিন আহেমদ প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একমত হওয়া সনদ থেকে সরে আসার অভিযোগ তোলেন। এসময় তিনি অত্যন্ত শক্ত ভাষা ব্যবহার করেন। বলেন, সংসদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। এতে ঐক্যের পরিবর্তে বিভজান তৈরি হবে বলে তিনি মনে করেন। সালাহ উদ্দিন আরো অভিযোগ করেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে কোনো সংস্থা গঠনের বিষয় ঐকমত্য কমিশনের এজেন্ডায় ছিল না। এব্যাপারে একমত হওয়া তো দূরের কথা, এটি নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। অথচ এখন এটির ওপর গণভোট অর্থাৎ হা বা না ভোট দিতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে আপার হাউজ গঠনকে একটি জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ বলে মনে করেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বক্তব্য শেষ করেন এ বলে যে, প্রধান উপদেষ্টা তার এ ভাষণে জুলাই সনদ লঙ্ঘন করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীরও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে, এখনো এ সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গত ১৩ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তারা এ প্রতিক্রিয়া জানান।
জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের কিছু কিছু বিষয়ে আরও ক্লারিফিকেশন দরকার। আমরা নিজেরা বসে পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব”। জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট অনুষ্ঠিত হলে এর গুরুত্ব অনেকটা চাপা পড়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ঘোষনায় জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। এটা একটা সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে সংকট নিরসনের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ৮টি সমমনা দল দাবি করে আসছি যে, গণভোটটা জাতীয় নির্বাচনের আগে করতে হবে। তাহলে এর আইনি ভিত্তিটা দৃঢ় হবে। এটা নিয়ে পরবর্তীতে আদালতে আইনি ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। সে সংকট কিন্তু রয়েই গেল।’
জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পারওয়ার তাৎক্ষণিকভাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে খুবই পরিষ্কার করে বলতে চাই যে প্রধান উপদেষ্টার একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণায় জনগণের আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়নি। জনগণের যে অভিপ্রায় ছিল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে কি কি বিষয়ে সংস্কার হলো? ইসলামী আন্দোলনের প্রধান চরমোনাইয়ের পীর সাহেব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, একই দিনে গণভোটের সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্খিত। মওলানা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে।
এনসিপির দাবি ছিল, কোনো অবস্থাতেই তাদের ভাষায় বাকশালী প্রেসিডেন্টের সই করা আদেশ তাদের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। বস্তুত তারা প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীনকে অপসারনের দাবি করে আসছিল। এজন্য তারা বঙ্গভবন ঘেরাও করতেও গিয়েছিল। কিন্তু ঘেরাও করতে গিয়ে তারা দেখে যে তাদের যাওয়ার পূর্বেই সেনাবাহিনী বঙ্গভবনকে ঘিরে রেখেছে। এছাড়া বিএনপিও সাংবিধানিক সঙ্কটের অজুহাত দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীনকে অপসারনের বিরোধিতা করে। কাজেই এনসিপির কাছে যে এই বাস্তবায়ন সনদ গ্রহনযোগ্য হবে না সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুরুতেই বলেছিলাম, শেখ হাসিনার প্রথম মামলার রায় ঘোষিত হবে আগামীকাল ১৭ নভেম্বর। স্বাভাবিকভাবেই এ রায় কি হবে সেটি নিয়ে জনগণের মধ্যে রয়েছে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। রায় কী হবে সেটি আমরা কেউ বলতে পারবো না। তবে চিফ প্রসিকিউটার তাজুল ইসলাম বলেছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং ডিজিটাল তথ্য দিয়ে তারা সমস্ত অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন। তাই তিনি মাননীয় আদালতের কাছে ৩ আসামীর, অর্থাৎ শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন।
শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, সে আশঙ্কা তার ভারতীয় প্রভুরাও করছেন। ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করেই তাদের নাশকতা এবং সন্ত্রাসী রূপ বাংলাদেশের মানুষ গত কয়েকদিন দেখলেন। এখন আগামীকাল রায় ঘোষিত হবে। এজন্য দেশে চরম অশান্তি সৃষ্টির জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠবে। অবশ্য একটি কথা তারা ভুলে যায়। সেটি হলো, মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না তেমনি সন্ত্রাসীরাও জনগণের সমর্থন বা আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া টিকতে পারে না। ১৩ তারিখকে কেন্দ্র করে তারা কিছু করতে পারেনি। তেমনি ১৭ তারিখকে কেন্দ্র করেও তারা কিছু করতে পারবে বলে জনগণ মনে করেন না। ১৩ তারিখকে কেন্দ্র করে যেমন অনেকগুলো বাস পোড়ানো হলো, অনেকগুলো ককটেল ফাটানো হলো, জুলহাস নামে এক বাস ড্রাইভারকে পুড়িয়ে মারা হলো, তেমনি এবারেও ওরা নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরার মতো সন্ত্রাসী কাজ করতে পারে। তবে দেশ প্রেমিক জনগণকে শুধু সজাগ হলেই চলবে না, পারলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।