আসিফ আরসালান
স্থির করেছিলাম, জুলাই সনদের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে লিখবো। জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে গত শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। সময় ছিলো বিকেল ৪টা। এর আগে জুলাই সনদ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি এবং বিএনপির অবস্থান ছিলো বিপরীত মুখী। লন্ডনে তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের পর থেকে ড. ইউনূস বিএনপির সব কথাই মেনে নিচ্ছেন। বিএনপিও বিনিময়ে ড. ইউনূসকে শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছে। এতদিন মনে হচ্ছিল যে বিএনপি ড. ইউনূসকে শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু সকলের সে ভুল ভেঙে দিয়েছেন স্বয়ং বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। গত ১৫ অক্টোবর বুধবার জুলাই সনদ স্বাক্ষর সংকটে নিক্ষিপ্ত হলে ড. ইউনূস সবগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে ‘অতি জরুরি বৈঠকে’ বসেন। এর আগের দিন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রিয়াজের সাথে এনসিপির প্রেসিডেন্ট নাহিদ ইসলামের সাথে একটি অনানুষ্ঠানিক এবং অঘোষিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এনসিপি প্রধান আলী রিয়াজকে সাফ জানিয়ে দেন যে, জুলাই সনদ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার চিত্র না জানা পর্যন্ত এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টার পর ৩০টি দলের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সালাহ উদ্দিন আহমেদ সকলের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ড. ইউনূসকে তারা যে সমর্থন দিয়েছেন সেটি শর্তহীন নয়। তিনি আরো বলেন যে, এ সমর্থন অনন্তকাল ধরে দেওয়া হবে না। এ সমর্থনের একমাত্র শর্ত ছিলো ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান। আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন যে, তাদের মধ্যে একটি দ্বিধা ছিলো, নির্বাচন আদতেই হবে কিনা। কিন্তু যখন ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন তখন বিএনপির মধ্যে এসম্পর্কিত দ্বিধা দ¦ন্দ¦ দূর হয়ে যায়। এরপর তিনি যখন ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেন তখন তারা নিশ্চিত হন যে, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। এটি ছাড়া তাদের আর কোনো এজেন্ডা ছিল না। কিন্তু জুলাই সনদ সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছিল। সে এজেন্ডা ধরেই এনসিপি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি। এ সম্পর্কে ১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে এনসিপির প্রেসিডেন্ট নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা দেখেছি জুলাই ঘোষণাপত্রের সময় আইনি ভিত্তি হয়নি, সেটার টেক্সট নিয়ে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। যেটা দেখানো হয়েছিল, ঘোষণাপত্র পাঠের সময় সেটা পরিবর্তিত ছিল, কমপ্রোমাইজড একটা ডকুমেন্ট হয়েছে।’
‘তাই আমরা আরেকটা এমন ঘটনার সাক্ষী হতে চাই না যেটার আসলে কোনো অর্থ নেই। আমরা আইনি ভিত্তি এবং আদেশের ব্যাপারে নিশ্চয়তা ছাড়া যদি জুলাই সনদে সই করি তা মূল্যহীন হবে’Ñ বলেন তিনি।
এনসিপি আহ্বায়ক আরও বলেন, ‘সরকার কিসের পরিপ্রেক্ষিতে আদেশ দেবে, কোন টেক্সট সেখানে থাকবে-সে বিষয়টা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা জুলাই সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানে নিজেরা অংশীদার হব না।’
এনসিপির পক্ষ থেকে নাহিদ ইসলাম তিনটি দাবি তোলেন। দাবিগুলো হলো, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া ও গণভোটের প্রশ্ন আগে থেকেই চূড়ান্ত করে জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। এ আদেশ জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস জারি করবেন এবং গণভোটে জনগণ সনদের পক্ষে রায় দিলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। পরবর্তী সংসদ ‘কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ হিসেবে ২০২৬ সালের নামে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে - বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬।
জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম ও জাগপা’র অবস্থান ছিলো, নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে। জুলাই সনদ যেনো আইনী ভিত্তি বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় সেজন্য গণভোট দিতে হবে। গণভোট অনুষ্ঠানে বিএনপি রাজি হয়। কিন্তু গণভোটের সময় নিয়ে বিএনপির সাথে ওপরে উল্লিখিত ৭ দলের মতভিন্নতা দেখা দেয় । বিএনপি দাবি করে যে, যেদিন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ঐ দিনই জুলাই সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ৭ দল দাবি করে যে, জাতীয় নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের ওপর গণভোট হতে হবে। গণভোটে জুলাই সনদ গৃহীত হলে ঐ সনদের ভিত্তিতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐ ৭ দলের আরেকটি বড় দাবি ছিলো, জাতীয় সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। সংসদের উভয় কক্ষেই নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। সংক্ষেপে এটি এখন পিআর নামে পরিচিতি লাভ করেছে। জামায়াতের যুক্তি হলো, যদি জাতীয় নির্বাচনের দিন জুলাই সনদের ওপর গণভোটও অনুষ্ঠিত হয় তাহলে উচ্চকক্ষের বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে। আরো বেশি করে চাপা পড়বে উচ্চকক্ষে পিআর সিস্টেমটি। কারণ বিএনপি এটি পরিস্কার করে বলেছে যে, তারা পিআর সিস্টেমের বিরোধী। তারা সংসদের আসন ভিত্তিতে নির্বাচন করতে চায়।
যা হোক এনসিপি ছাড়া বড় দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে, তাপরও একটি বিষয় কিন্তু অস্পষ্টই রয়ে গেলো। সেটি হলো, জুলাই সনদ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে? এনসিপি বলেছিলো, নির্বাচনের আগে বিপ্লব উদ্ভূত সরকার এই সনদ ঘোষণা করবে। পক্ষান্তরে অন্যরা বলছেন যে, প্রেসিডেনশিয়াল প্রোক্লামেশন বা প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ফরমান বলে জুলাই সনদ ঘোষিত হবে। এর পর যদি জাতীয় নির্বাচনের দিনেও গণভোট হয় তাতে তাদের আপত্তি নাই। কিন্তু এক্ষেত্রে বিএনপি বলে যে, ইউনূসের সরকার বিপ্লব উদ্ভূত সরকার নয়। যেহেতু তারা সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্ট থেকে মতামত এনেছে এবং সে মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করেছে তাই এটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার একটি সরকার। অর্থাৎ এটি সাংবিধানিক সরকার, বিপ্লব উদ্ভূত সরকার নয়। আর ঠিক সে কারণে প্রেসিডেন্ট বলুন আর প্রধান উপদেষ্টা বলুন, কারো সাংবিধানিক ফরমান জারি করার মতো Constituent Power বা সাংবিধানিক ক্ষমতা নাই। অবশ্য প্রথমে তারা বলেছিল যে, এসব সাংবিধানিক সংস্কার করবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট। পরে তারা সে অবস্থান থেকে সরে আসে এবং গণভোটের মাধ্যমে সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ায় রাজি হয়।
৮৪টি প্রস্তাব বা সুপারিশ সম্বলিত জুলাই সনদের কোথাও এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি যে কবে কিভাবে এ সনদের বাস্তবায়ন হবে। এনসিপি বিষয়টি উল্লেখ করলে ড. আলী রিয়াজ বলেন যে, সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এক বা একাধিক সুপারিশ বা প্রস্তাব সরকারের নিকট পেশ করবে। প্রশ্ন হলো, কবে সেসব প্রস্তাব দেয়া হবে এবং কবে সেসব প্রস্তাবের ওপর ঐকমত্য হবে? গত বুধবার ৩২টি রাজনৈতিক দলের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। উত্তরে আলী রিয়াজ বলেন, স্বাক্ষর হওয়ার পর বিষয়টি তারা টেক আপ করবেন। সোজা ভাষায় বলা যায়, সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুটি ঝুলে গেলো।
বিএনপি খুব আত্মবিশ্বাসী যে, তারা বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করবে। জয় পরাজয়ের ব্যাপারটি অগ্রিম বলা যায় না। কারণ বিগত ১৫ বছরে জনগণের বিশেষ করে ১৮ থেকে ৪০ বছরের Age group এর মাইন্ড সেট কি সেটি কারো জানা নেই। কারণ গত ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই তাদের মনের খবর সকলের কাছে অজানা। তবে বিএনপি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করেছে যে, তারা যদি নির্বাচিত হয় তাহলে যেসব বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি তুলেছে সেসব বিষয় তারা বাস্তবায়ন করবে না। অথচ যে ৯টি বিষয়ে তারা আপত্তি তুলেছে সে ৯টি বিষয়ই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তনকে রুখে দিতে পারে। ঐ ৯টি বিষয় যদি বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট হারিয়ে যাবে। ব্যাপারটি দাঁড়াবে অনেকটা, ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।’
এ আশঙ্কাটি করছেন এখন অনেকেই। সাবেক সেনা প্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া প্রায়শই ফেসবুকে পলিটিক্যাল পোস্ট দেন। তার সর্বশেষ পোস্টে তিনি বলেছেন, জুলাই বিপ্লব জনগণের সামনে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ার এক সুর্বণ সুযোগ এনে দেয়। তার ভাষায়, ফরাসি বিপ্লবের ৩ আদর্শ স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দেশ ও সমাজ গঠনের সুযোগ উন্মোচিত হয়।
কিন্তু তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘দুঃখজনকভাবে, দেশটি ভিন্ন পথে গেল। সুযোগ গ্রহণের বদলে দ্রুত পরাজিত দলের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করে পুরোনো কাঠামোকেই আবার জোড়া লাগানো হলো। পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সিভিল প্রশাসন সবই দলীয় নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। গুরুত্বপূর্ণ পদ হঠাৎ করে দখল হলো এবং জুলাই বিপ্লবের দোষীদেরকে শাস্তি দেওয়ার আগেই সরকারি নিয়ম ভেঙে দ্রুত পদোন্নতি ঘটতে থাকলো। আগের শাসকগোষ্ঠীর সম্পদ ও ব্যবসা হাতবদল হলো এবং বেআইনি চাঁদাবাজি চলতে থাকলো। দেশের সর্বত্র বিভিন্ন পোস্টারে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবির বদলে নতুন মুখমণ্ডল শোভা পেতে লাগলো। মহাসড়ক ও প্রধান সড়কে নির্মিত বিভিন্ন তোরণে বিএনপি নেতৃবৃন্দের ছবি আমাদের স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিল যে পুরনো চর্চাই অব্যহত থাকবে। সারকথা- পুরাতন শিকারির দলকে একটি নতুন শিকারীর দল প্রতিস্থাপন করল।’
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তাড়াহুড়ার কাছে হার মেনেছেন ড. ইউনূস। আর সে হার মানতে গিয়ে বিডিআর ম্যাসাকার, শাপলা ম্যাসাকার, সাগর রুনি সহ অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার চাপা পড়ে গেল। ১৪০০ ছাত্র জনতা প্রাণ দিলেন এবং ২৬ হাজার লোক বুলেটবিদ্ধ হয়ে আহত হলেন। সে কি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য?