দেশপ্রেম কারো গায়ে লেখা থাকে না। আবার কেউ দেশদ্রোহী হয়েও জম্মায় না। সময়-পরিস্থিতি ও সমাজ এ তিন মিলেই কাউকে করে তোলে হিরো কিংবা জিরো। তবে জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন এ লেখার কেন্দ্রবিন্দু। একজন চিকিৎসক হয়েও যিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি হাসপাতালের চার দেয়ালে, বরং হয়ে উঠেছেন এক জনদরদি রাজনৈতিক নেতা- নির্লোভ, নীতিনিষ্ঠ ও বিনয়ী নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। তিনি শুধু নেতৃত্ব দেন না, মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার হয়ে উঠতে গিয়ে হয়েছেন আলোচিত, হয়েছেন সমালোচিতও; তবু কখনো নিজের আদর্শচ্যুতি ঘটাননি। দিন রাত শ্রম দিয়ে, শত বাধা উপেক্ষা করে মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর মানবিক অবস্থান, নৈতিক দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ তাঁকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে করে তুলেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যেখানে আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে তাঁর নির্লোভ, নীতিনিষ্ঠ, বিনয়ী নেতৃত্ব এক নতুন দৃষ্টান্ত। নিন্দুকদের কটাক্ষের জবাবে তিনি দেন নীরব জনসেবা, যেটা তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়। তিনি আর কেউ নন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তার মানবিকতা তাঁকে মানুষের হৃদয়ের গহীনে স্থান করে দিয়েছে, যা সাধারণত সবার ভাগ্যে জুটে না। ডা. শফিকুর রহমান রাজনীতিকে দেখেছেন আদর্শিক সংগ্রাম হিসেবে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা অন্যায় কিছু নয়; বরং স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি অশোভন। সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন জনকল্যাণকামী রাজনীতির চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে তখন প্রচারবিমুখ বিনয়ী ডা. শফিকুর রহমান উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন এক মানবিক নেতৃত্বের। তিনি রাজনীতিকে আদর্শিক সংগ্রাম এবং শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও মানবিকতাকে করেছেন পথচলার মূল শক্তি। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন রাজনীতিবিদরা। রাষ্ট্রের জনগণ যখন নিপীড়নের শিকার হন তখন রাজনীতিবিদদেরই প্রতিবাদ করতে হয়। রাষ্ট্র চালাতে শুধু আমলাতন্ত্র যথেষ্ট নয়। একটি রাষ্ট্র তখনই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে যখন সৎ,দক্ষ ও আদর্শবান নেতৃত্ব জাতিকে পথ দেখায়।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যত প্রপাগান্ডা, মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হয়েছে তা অন্য কোনো দলের বেলায় দেখা যায়নি। ১৯৪১ সালে দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর হাত ধরে যাত্রা শুরু করা এ দল আজও দাঁড়িয়ে আছে মজবুত ভিত্তির ওপর। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও জামায়াত ফোবিয়া থামেনি। পতিত স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নির্মূল করতে চেয়েছিল। নিষিদ্ধ করে রাজনৈতিক মাঠ থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা গোটা জাতির জন্য ইসলামী আন্দোলনকে ওপেন করে দিয়েছেন। শুধু ওপেন-ই করেননি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল জননেতা এটি,এম, আজহারুল ইসলামকে কথিত যুদ্ধপরাধের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, যা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মিথ্যাচারের স্পষ্ট প্রতিফলন।
গত ১৯ জুলাই ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জনসভায় লাখো মানুষের ঢল নামে। জনস্রোতের সে মঞ্চে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুবার চেষ্টা করেও দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে পারেননি, তবু বসে থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন-‘‘ আমরা ফ্যাসিবাদ বিতাড়িত করেছি। দুর্নীতিও বিতাড়িত করবো। চাঁদা নেব না, দুর্নীতি করব না, সহ্যও করব না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখ থেকে প্রায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা আমরা শুনি। কিন্তু আমীরে জামায়াত যে দৃঢ়তার সাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন তা অন্য কোন নেতার মুখে বলতে শোনা যায়নি। নিন্দুকেরা তাঁর অসুস্থতাকেও নাটক বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্ত জনগণ তা আমলে নেয়নি। এরই মাঝে সোমবার বেলা দেড়টার দিকে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ভবনে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান তিনি। নিন্দুকেরা তখনও কটাক্ষ করেছে। অথচ তিনি দলীয় তহবিল থেকে ৫০ লক্ষ টাকা এবং ২০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলিত। নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। দলের আমীর একক সিদ্ধান্ত নেন না; পরামর্শের ভিত্তিতে হয় সকল সিদ্ধান্ত। এটি এক শিক্ষনীয় রাজনীতির মডেল। ডা. শফিকুর রহমান তাঁর পূর্বসূরিদের মতো যোগ্যতা নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন,তবে তাঁকে ব্যতিক্রম বলা চলে তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। তিনি দল পরিচালনার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আদর্শিক অবস্থানে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, একজন মানবিক সংগঠক। পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর দুর্ঘটনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৮০টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শুধু সহানুভূতির বাণী নয়, অর্থনৈতিক অনুদান দিয়ে তাঁদের কষ্ট লাগবে চেষ্টা করেছেন। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত পরিবারের পাশে ডা.শফিকুর রহমান দাঁড়িয়েছিলেন। সমবেদনা ও আর্থিক সহযোগিতা বাবদ ২১ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করেছিলেন।
সবকিছুর ওপর মানবতা। জামায়াত যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তা সামান্য। নৌকাডুবিতে মৃত্যু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের কষ্ট। তা লাঘবে রাজনৈতিক দলসহ সবার এগিয়ে আসা উচিত। তিনি আরো বলেন- নৌকাডুবির ঘটনা একটি বড় মানবিক বিপর্যয়। এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু দেশের ইতিহাসে বিরল। নিহতরা সবাই হিন্দু ধর্মের হলেও আমরা বিষয়টি সেভাবে দেখছিনা। মানুষ বিপদে পড়েছে, আমরা পাশে দাঁড়িয়েছি। এ সহযোগিতা আমাদের দয়া কিংবা অনুগ্রহ নয়; বরং বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সামাজিক দায়িত্ব। ২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। সে বন্যায় ডা. শফিকুর রহমান দলীয় ফান্ড থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার অনুদান প্রদান করেছিলেন। নিজে হাঁটু সমান পানি, কাদা মাড়িয়ে অসহায় বানভাষী মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ পরিবারের নিকট ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি দলের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ২ লাখ টাকার করে অনুদান দিয়েছেন। এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। তিনি বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, নৌদুর্ঘটনা, শহীদ পরিবার, গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা -সবখানে তাঁর মানবিকতার ছোঁয়া রয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জনগণের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের কল্যাণে কাজ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য অদ্যাবধি পর্যন্ত কোন সরকারই ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে জনগণের কল্যাণের কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের অধিকারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অথচ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি দলের প্রধান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকেও জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন- যা সত্যিই প্রশংসারযোগ্য। রাজনীতিকে আদর্শিক ও মানবিক করার যে স্বপ্ন তিনি লালন করেন, যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়-তবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম পাবে এক নতুন নেতৃত্বের স্বাদ; যেখানে ক্ষমতা নয়; বরং আদর্শ, সততা ও সেবাই হবে মূল চালিকাশক্তি। ডা. শফিকুর রহমান এক অবিচল মানুষ-যিনি প্রচারের আলোয় নয়, নৈতিকতার শক্তিতে মানুষ গড়ার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছেন। তাঁর এই নি:স্বার্থ, নি:শব্দ জনসেবা একদিন ইতিহাসের পাতায় সম্মানের সঙ্গে লেখা থাকবে গৌরবের অক্ষরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।