জাফর আহমাদ

সেজদা মানে সালাত, সালাত মানে সেজদা। সেজদা আমরা সালাতেই দেখতে পাই। এ জন্য যে স্থানে সালাত পড়া হয় তাকে মুসল্লা না বলে আমরা মসজিদ বলে থাকি। মসজিদ মানে সেজদা করার স্থান। আর মুসল্লা মানে সালাত পড়ার স্থান। মাথা, কপাল, নাক ও হাঁটু গেড়ে মহান আল্লাহর দরবারে নিজেকে লুটিয়ে দেয়ার নাম সেজদা। এটি বান্দা-মালিকের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আদান প্রদান। সুতরাং যতক্ষণ সক্ষমতা আছে আপনার আভিজাত্যের ঐ অঙ্গগুলো দিয়ে বেশি বেশি আল্লাহকে সেজদা করুন। বিশেষত হাটু, কোমর ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই বেশি বেশি করে আল্লাহকে সেজদা করতে থাকুন বা সালাত পড়তে থাকুন। সুস্থতা যতক্ষণ অছে বিশেষত অসুস্থ হয়ে পড়ার আগেই মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বেশি বেশি সেজদা করুন। কারণ অচিরেই হয়তোবা কোমর বা হাটু ব্যথার কারণে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সাজদা করার মত অমূল্য নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আল্লাহ তা’আলার তরে সেজদা করা এক সৌভাগ্যের কর্ম। নিজের সাতটি অঙ্গ তাঁর সামনে লুটিয়ে দিয়ে নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করে দেয়া সত্যিই এক অর্ভূতপূর্ব দৃশ্য। ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ। আর আত্মসমর্পনের বাস্তবরূপ বা দৃশ্য প্রতিফলিত হয় সাজদা নামক কর্মে। সাজদা এমন একটি কর্ম যার গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল কুরআন ও রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর হাদীসে ইবাদাত ও পুরো সালাতকে সাজদা নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন আল কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা রুকু করো এবং সাজদা করো।” (সুরা হাজ্জ : ৭৭) আল্লাহ আরো বলেন, “আমার আয়াতের প্রতি তো তারাই ঈমান আনে যাদেরকে এ আয়াত শুনিয়ে যখন উপদেশ দেয়া হয় তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজেদের রবের প্রশংসা সহকারে তার মহিমা ঘোষনা করে এবং অহংকার করে না।” (সুরা আস সাজদা : ১৫)

রাবী’আহ ইবনে কাব আল আসলামী (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে রাত যাপন করছিলাম। আমি তার ওযুর পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দিতাম। তিনি আমাকে বললেন: কিছু চাও! আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সাহচর্য প্রার্থনা করছি। তিনি বললেন, এছাড়া আরো কিছু আছে কি? আমি বললাম, এটাই আমার আবেদন। তিনি বললেন, তাহলে তুমি অধিক পরিমাণে সিজদা করে তোমার নিজের স্বার্থেই আমাকে সাহায্য করো। (মুসলিম : ৯৮১, আন্তর্জাতিক নং ৪৮৯, কিতাবুস সালাত, বাবু ফাযলিস সুজুদ ওয়া হিস্সি আলাইহি, ইফা : ৯৭৬, ই. সে : ৯৮৭)

দুনিয়াতে নবী (সা:) এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন আসহাবুর রাসুল (সা:)। দুনিয়ার জীবনে কোন মু’মিন ব্যক্তির কপালে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সাহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য আর কোনদিন জুটবে না। তাই এমন কর্মনীতি গ্রহণ করুন যাতে অন্তত: আখিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছাকাছি থাকতে পারেন। উল্লেখিত হাদীসে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা:) সে সুযোগের কথা বিবৃত করেছেন। বেশি বেশি করে সেজদা করুন অর্থাৎ সালাত আদায় করুন। তাহলে জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করতে পারবেন বলে রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন।

সাজদার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মারয়াম! তোমার রবের ফরমানের অনুগত হয়ে থাকো। তাঁর সামনে সিজদানত হও এবং যেসব বান্দা তাঁর সামনে অবনত হয় তুমিও তাদের সাথে অবনত হও।” (সুরা আলে ইমরান: ৪৩) কারণ তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমাজের লোকেরা যে অপবাদ দিচ্ছিলো, তাতে তিনি ব্যাথা পাচ্ছিলেন। একই কারণে নবী (সা:) আল্লাহ তা’আলা সিজদার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি জানি, এরা তোমার সম্বন্ধে যেসব কথা বানিয়ে বলে তাতে তুমি মনে ভীষণ ব্যথা পাও। এর প্রতিকার এই যে, তুমি নিজের রবের প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করতে থাকো, তাঁর সকাশে সিজদাবনত হও এবং যে চুড়ান্ত সময়টি আসা অবধারিত সেই সময় পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো।” (সুরা হিজর : ৯৭-৯৯)

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যেদিন পায়ের গোছা অনাবৃত করা হবে” (কঠিন সময় এসে পড়বে) এবং সিজদা করার জন্য লোকদেরকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা সিজদা করতে সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি হবে অবনত। হীনতা ও অপমানবোধ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এর আগে যখন তারা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলো তখন সিজদার জন্য তাদেরকে ডাকা হতো (কিন্তু তারা অস্বীকৃতি জানাতো)।” (সুরা কলম : ৪৩-৪৩) এখানে সাজদা মানে আল্লাহর ইবাদাত। দুনিয়াতে কে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাত করতো আর কে তাঁর বিরোধী ছিলো কিয়ামতের দিন প্রকাশ্যে তা দেখানো হবে। এ উদ্দেশ্যে লোকদেরকে আল্লাহ তা’আলার সামনে সিজদাবনত হওয়ার আহবান জানানো হবে। যারা দুনিয়াতে আল্লাহর করতো তারা সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু দুনিয়াতে যারা আল্লাহকে সিজদা করেনি, তাদেও কোমর শক্ত ও অনমনীয় হয়ে যাবে। তাদের পক্ষে ইবাদাতগুলোর বান্দা হওয়ার মিথ্যা প্রদর্শনী করা সম্ভব হবে না। তারা লাঞ্জিত ও অপমানিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

সালাতের বাইরে তিন প্রকারের সাজদা রয়েছে। এক, সাজদায়ে শোকর: কোন আনন্দ বা সাফল্যের সংবাদ শোনার পর কালিমাতুশ শোকর তথা আলহামদুলিল্লাহ বলার সাথে সাথে সাজদায়ে শোকর তথা যে মহান রব এ সাফল্য দান করলেন, তাঁর সামনে নিজেকে লুটিয়ে দেয়া। দুই, সাজদায়ে তেলাওয়াত: তথা আল কুরআন তেলাওয়াত কালে কিছু সাজদার আয়াত আছে। এ আয়াতগুলোর তেলাওয়াত শেষ করে নিজেকে তাঁর সামনে লুটিয়ে দেয়া। তিন, সাজদায়ে সুহু: সালাতে ভুল হলে এই সাজদা ওয়াজিব হয়। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু আল্লাহর কাছে মাথা নত করে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন: আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহর সাজদা করে।” (সুরা রা’আদ : ১৫) আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এই রাত ও দিন এবং চন্দ্র ও সুর্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। সুর্য ও চাঁদকে সিজদা করো না, সে আল্লাহকে সিজদা করো যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, যদি সত্যিই তোমরা তাঁর ইবাদাতকারী হও।” (সুরা হামিম সিজদা : ৩৭)

সালাত বা সালাতের বাইরে সাজদা এমন একটি কর্ম যার মাধ্যমে মানুষ তার সকল প্রকার অহংকারবোধ, অযথা সব মর্যাদা, আভিজাত্য, আমিত্ব, গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমানকে এক পেশে ঠেলে দিয়ে সারা জাহানের প্রভু, পরম দয়ালু মনিব, সার্বভৌম ক্ষমতার নিরংকুশ মালিক, পরাক্রমশালী রাজাধিরাজ, ইজ্জত-অপমানের একমাত্র মালিকের সামনে মর্যাদার প্রতীক তথা মাথা, কপাল ও নাক মাটিতে লুটিয়ে দেয়। আনুগত্যের এ সুন্দর দৃশ্যটি সাজদা ছাড়া কোথাও এভাবে পরিলক্ষিত হয় না। সাজদার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ রাবুল আলামীনের সমীপে আরজ করি “তুমি সকল প্রকার দুর্বলতা, অক্ষমতা. অপারগতা, অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। আমি দুনিয়ার সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র তোমারই সামনে নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে আমি তোমার মহানত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।’ আমার সকল অহংবোধ, আভিজাত্য, মর্যাদা সকল কিছুকে তোমার সমীপে লুটিয়ে দেয়াকে নিজের অপমাণ নয় বরং সম্মানবোধ করছি, এজন্য যে, আমি আমার মর্যাদার এই প্রতীকগুলো যথার্থ সৃষ্টিকর্তার সামনেই লুটিয়ে দিতে পেরেছি।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল! আর যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন এবং নিজেরা পরস্পর দয়াপরাবশ। তোমরা যখনই দেখবে তখন তাদেরকে চেহেরায় সিজদার চিহ্ন বর্তমান যা দিয়ে তাদেরকে আলাদা চিনে নেয়া যায়। তাদের এ পরিচয় তাওরাতে দেয়া হযেছে।” (সুরা আল ফাতাহ : ২৯) সিজদা করতে করতে কোন মুসল্লীর কপালে যে দাগ পড়ে তা এখানে বর্ণনা বুঝানো হয়নি। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাভীরুতা, হৃদয়ের বিশালতা, মর্যাদা এবং মহৎ নৈতিক চরিত্রের প্রভাব যা আল্লাহর সামনে মাথা নত করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কোন মানুষের চেহেরায় ফুটে উঠে। একজন অহংকারী মানুষের চেহেরা ্একজন বিনম্্র ও কোমল মানুষের চেহেরা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন দুশ্চরিত্র মানুষকে একজন সচ্চরিত্র ও সৎমনা মানুষ থেকে আলাদা করার চিহ্ন তার চেহেরায় দেখতে পাওয়া যায়। একজন গুন্ডা ও দুশ্চরিত্র চেহেরা-আকৃতি এবং একজন সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র ব্যক্তির চেহেরা-আকৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকে। আল্লাহ তা’আলার এ উক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহাম্মদ (সা:) এর সংগী-সাথীরা এমন যে কেউ তাদেও একবার দেখা মাত্রই অনুধাবন করতে পারবে তারা সৃষ্টির সেরা। কারণ তাদের চেহেরায় আল্লাহ ভীরুতার দীপ্তি সমুজ্জল।

সাজদার মাধ্যমে ইসলামের গোটা রূপটি দৃশ্যমান হয়। ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। সাজদা হলো, এ আত্মসমর্পণের বাস্তবরূপ বা দৃশ্য। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হলো মনিব-গোলাম। মনিব-গোলামের এ সম্পর্কের বাস্তব অনুশীলন দেখার জন্য সাজদাই হলো উপযুক্ত কর্ম। কপাল-নাক মাটিতে রেখে গোটা দেহ সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিয়ে গোলাম তার মহান মনিবের নিকট ধরনা দেয়ার এ সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই গোলামী করো এবং আমার কথা সর্বদা মনে রাখার জন্য সালাত কায়েম কর।” (সুরা ত্বহা : ১৪)

লেখক : ব্যাংকার।