অসুস্থ হলে আমরা সবাই দ্রুত সুস্থ হওয়ার আশায় ওষুধ সেবন করি; কিন্তু সে ওষুধটিই যদি অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো আর দুঃখের সীমা থাকে না। প্রতিনিয়তই আমরা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনি; কিন্তু খুব কম মানুষই কেনা ওষুধের মেয়াদ যাচাই করে। অনেকেই আবার শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় বাসায় আগাম ওষুধ মজুত রাখি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তবুও আমরা সেগুলো সেবন করি। ফল কখনও কখনও সুখকর হয় না, ভয়াবহ হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শরীরের জন্য ওষুধ নয়, বিষে পরিণত হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনে শারীরিক ক্ষতি হয়, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। ওষুধ কেনা অপরাধ নয়, বরং এটি প্রয়োজনীয়তা; কিন্তু মেয়াদ দেখে সেবন করা অত্যন্ত জরুরি। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের তারিখ কেটে তা বিক্রি করে। রোগীরা প্রতারিত হন। আর ওষুধ সেবনের পর আরোগ্যের পরিবর্তে নতুন নতুন জটিলতা দেখা দেয়।

আমাদের দেশে সামান্য অসুস্থতা দেখা দিলেই অনেকে নিজেই চিকিৎসক সেজে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। ফার্মেসির বিক্রেতারাও অনেক সময় প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বা শক্তিশালী ওষুধ বিক্রি করেন। এতে রোগীদের তাৎক্ষণিক আরাম মিললেও দীর্ঘমেয়াদে শরীরে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সুতরাং আমরা মনে করি, সুস্থ থাকার জন্য ওষুধ যতটা জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি সঠিক ও নিরাপদ ওষুধ ব্যবহার করা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কখনোই নিরাপদ নয়। তাই ওষুধের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লেখা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি অনুপস্থিত থাকলে বা উপেক্ষা করলে মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারণ মেয়াদ উত্তীর্ণের আগে ওষুধ তার পূর্ণ কার্যকারিতা দেখায়; কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এর গুণগত মান কমে যায় এবং রোগ নিরাময়ে কার্যকর হয় না। তাই সকলের উটিত সচেতন হয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করা।

আমরা মেয়াদোত্তীর্ণ দুধ, টিনজাত খাবার বা পানীয় গ্রহণে বিরত থাকি। কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে এতটা সতর্ক হই না। অথচ ওষুধের প্যাকেটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে- উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদের শেষের তারিখ। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ওষুধের কার্যকারিতা থাকে না। এটি জানা সত্ত্বেও অনেকেই চোখ বুঝে ফার্মেসির বিক্রেতার ওপর নির্ভর করি, যা মোটেও উচিত না। দেশে প্রায় ২৮৫টির মতো ওষুধ কোম্পানি আছে। অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানি প্যাকেটে তারিখ লিখলেও অনেক সময় ওষুধের পাতায় তারিখ এতটাই অস্পষ্টভাবে লেখা থাকে যে পড়া যায় না। ফলে একজন রোগী সহজেই বুঝতে পারেন না ওষুধটি মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা। আবার অনেক ফার্মেসি মালিক ইচ্ছাকৃতভাবে ওষুধের পাতা এমনভাবে কাটেন যেন মেয়াদ অংশটি দেখা না যায়। এতে সাধারণ মানুষ ও রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। ওষুধের দোকান কোনো সাধারণ মুদি দোকান নয়! এটি একটি সংবেদনশীল ব্যবসা, যেখানে প্রতিটি পণ্য সরাসরি মানুষের জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ বাস্তবতা হলো-নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে অসংখ্য ফার্মেসি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯১টি ওষুধের দোকান রয়েছে, এর মধ্যে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৯৩টি ফার্মেসির নিবন্ধন মেয়াদোত্তীর্ণ। তদারকির অভাবে এসব দোকানের বেশিরভাগেই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট নেই। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে সাধারণ রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। প্রেসক্রিপশন অনুসারে ওষুধ চাইলেও দিতে পারেন না। কারণ তারা প্রেসক্রিপশন বোঝেন না।

প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধের নাম বা জেনেরিক বোঝার কোন উপায় নেই। একজন রোগী যখন চিকিৎসার স্বার্থে বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তখন একই ওষুধ কখনো কখনো দু’বার হয়ে যায়। কিন্তু রোগীরা তা ধরতে পারেন না। কারণ আমাদের দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলোর একই ওষুধ বিভিন্ন নামের হয়। জেনেরিক নাম থাকলেও রোগীরা তা বুঝতে পারেন না। যদি শুধু জেনেরিক নাম দিয়ে ওষুধ বিক্রি করা হতো, তাহলে চিকিৎসকরা কোন কোম্পানির কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করতে পারতেন না। আর রোগীদেরও ওষুধ কিনতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হওয়া লাগতো না। আমরা মনে করি, সকল কোম্পানির ওষুধ জেনেরিক নাম দিয়ে বিক্রি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

কিছু চিকিৎসকদের হাতের লেখা স্পষ্ট হলেও অধিকাংশ চিকিৎসকের হাতের লেখা বোঝা যায় না। অনেক সময় রোগীকে দ্বিতীয়বার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে- ২০১৭ সালে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন স্পষ্ট ও বড় হরফে লিখে বা ছাপিয়ে রোগীকে দিতে হবে। ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সে নির্দেশনা কতটা মানা হচ্ছে তা ফার্মেসিতে গেলেই বোঝা যায়। দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় না। যে তাপমাত্রায় ওষুধ রাখার কথা, সে তাপমাত্রায় রাখা হয় না। ফলে ওষুধের গুণগত মানও বজায় থাকে না। প্রতিটি ওষুধের দোকানে দক্ষ ফার্মাসিস্ট রাখা বাধ্যতামূলক করা দরকার, কিন্তু বাস্তবে তা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ফার্মেসি জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এ প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন।

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কেনার ব্যাপারে ক্রেতাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কেনার আগে অবশ্যই তারিখ দেখে নেয়া জরুরি, কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ হতে পারে আপনার আমার মৃত্যুর কারণ। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারের ফলে প্রায়ই মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। মেয়াদোউত্তীণ ওষুধ আমাদের কোন উপকার করতে পারেনি; বরং ওষুধের অপকারিতাই বেশি। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ গ্রহণ করলে পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিরা, অ্যালার্জি বা বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক পার্শ¦প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। রোগ সারানোর পরিবর্তে নতুন রোগের জন্ম দেয়। পাশাপাশি বাড়ায় চিকিৎসা খরচ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও ওষুধ প্রশাসনকে বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও নজরদারির ব্যবস্থা করা দরকার।

একই সঙ্গে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ওষুধের প্যাকেটে ও পাতায় মেয়াদ স্পষ্টভাবে লেখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যদি কোনো কোম্পানি ওষুধের প্যাকেটে বা পাতায় তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানার বিধান চালু করা যেতে পারে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এমনভাবে মেয়াদ লিখতে হবে যাতে একজন সাধারণ রোগীও লিখিত তারিখ সহজে বুঝতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নাগরিকদের নিজের। প্রত্যেক ক্রেতার উচিত, ওষুধ কেনার আগে মেয়াদ যাচাই করা। সচেতন ভোক্তাই অসাধু ব্যবসায়ীকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রচারণা বাড়াতে হবে- ওষুধ কেনার আগে মেয়াদ দেখুন। ওষুধ আমাদের জীবনের সুস্থতার জন্য, মৃত্যুর জন্য নয়। তাই আরও সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন। আর নয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, নিরাপদ ওষুধই রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেÑ এমটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক