ক্ষমতা যে কখনো চিরস্থায়ী নয়, একথা ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সব সময়ই ভাবনার বাইরে ছিলো। মূলত, তারা যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারা ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করার জন্য নানাবিধ কদর্য পন্থা অবলম্বন করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। তারই অংশ হিসাবেই তারা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিলো। এখানেই শেষ নয় বরং তারা গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার জন্য মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়াত্ত পত্রিকা বাদে সকল গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তাদেরকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু এ থেকে তারা মোটেই শিক্ষা গ্রহণ করেনি।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে আবারো ক্ষমতায় এসে সে পুরনো অশুভ বৃত্তেই আটকা পড়েছিলো। তারা নিজেদের ক্ষমতাকে নির্বিঘ্ন করতেই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কবর রচনা করেছিলো। এ ভাবেই চলেছে তাদের প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসন। দলীয়করণ সহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো। জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণকে রাষ্ট্রাচারে পরিণত করা হয়েছিলো। নির্বাচনকে পরিণত করা হয়েছিলো প্রহসন ও তামাশার অনুষঙ্গ। তারা ধরেই নিয়েছিলো যে, রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের জন্য রীতিমত চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।

তবে কথায় আছে ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট তাদেরকে লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দলীয় পশুশক্তি কোন কাজে আসেনি বরং ক্ষমতা হারিয়ে পালাতে হয়েছে দেশ ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি বরং ক্ষমতা হারানোর বেদনায় তারা দেশ ও জাতিস্বত্ত্বাবিরোধী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।

মূলত, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া আওয়ামী লীগের পলাতক সাবেক মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যসহ শীর্ষ নেতারা প্রথম দিকে অনেকে নানাবিধ সামাজিক অনুষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছেন। আসলে বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ দেশি-বিদেশি চক্র এ এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা পুরোমাত্রায় সক্রিয় ছিলেন; এখনও আছেন এবং আগামী দিনেও থাকবেন। ষড়যন্ত্র সফল করতে কোর গ্রুপ তৈরি করে ঘনঘন বৈঠকে বসছেন তারা। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র তেমন কোন কাজ আসেনি।

পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে হটাতে বিদেশে বসে দেশের মধ্যে নানারকম ষড়যন্ত্র ও অঘটন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে খেপিয়ে তোলা যায়, সে পরিকল্পনাই অব্যাহত রেখেছে। তবে ষড়যন্ত্রের উত্তপ্ত কড়াইয়ে ঘি ঢেলে দিয়েছিলো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বর্তমান চীন সফর। এ সফরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয় ভারত। কারণ, ঢাকা যদি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার প্রশ্নে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে ড. ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বেশ বেগ পেতে হবে বলেই মনে করেছে তারা। তাই তারা এ সফর বেশ উষ্মাই প্রকাশ করেছে।

একথা কারো অজানা নয় যে, ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ এবং দলটির বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ শীর্ষনেতা, সাবেক মন্ত্রী এবং সংসদ-সদস্যরা পালিয়ে রয়েছেন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এছাড়া স্বয়ং পতিত প্রধানমন্ত্রী ভারতে বসে প্রতিদিনই টেলিফোনসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নানা নির্দেশনা দিয়ে উত্তক্ত করে চলেছেন শুরু থেকেই। এ সংক্রান্ত একাধিক অডিও কল রেকর্ড প্রায় ভাইরাল হওয়ার খবরও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কাকতালীয়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা প্রথমদিকে কিছুদিন চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তারা বেশ সরব এবং সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে কলকাতা, আগরতলা, দিল্লি, মেঘালয়সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া আওয়ামী লীগের নেতারা সম্প্রতি দফায় দফায় বৈঠক করছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতের নয়াদিল্লি ও কোলকাতায় এসব বৈঠকের মূল এজেন্ডা অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করা। দেশে নাশকতামূলক বড় ঘটনার যেসব গোয়েন্দা আভাস ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে, এর নেপথ্যে রয়েছে আওয়ামী এ কোর গ্রুপসহ দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র।

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের আগে ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সুসম্পন্ন হয়েছে। যদিও এ নির্বাচন বাঞ্চালের জন্য পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসররা অতিমাত্রায় তৎপর ছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি বরং এ নির্বাচনে আগস্ট বিপ্লবের প্রতিই ঢাবি শিক্ষার্থীরা অকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। চলমান রয়েছে আরো ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় তথা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের কার্যক্রম।

এ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে নতুন কৌশলে এগোচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রতিভূরা। যদিও ঢাকসুতে পুরোাপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাকি ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ষড়যন্ত্র ও কৌশল বাস্তবায়ন করতে নতুন করে নির্দেশনা আসছে বিদেশে পলাতক আওয়ামী নেতাদের কাছ থেকে। তাদের মূল টার্গেট জাতীয় সংসদ এবং বাকি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করা।

বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের মধ্যে অনুষ্ঠিত জুম মিটিংয়ে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, আইজিপির সঙ্গে জুম মিটিং শুরুর আগে ডিএমপির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনার। ওই বৈঠকের আলোচনায় বিদ্যমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। বৈঠক শেষে ডিএমপির উচ্চপর্য়ায়ের সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, ডাকসু-সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনকে অলআউট সাপোর্ট দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ডিএমপি। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ধরনের সহযোগিতা চায়, সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়। সে ধারাবাহিকতায় নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে নির্বাচনের আগের কয়েক দিন প্যাট্রোলিং বাড়ানো হয়। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ডেপ্লয়মেন্ট আরও বাড়ানো হয়েছিলো বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি পয়েন্টে রাখা হয় সার্বক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনাও দেয়া হয়। ফলে গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণভাবে সুসম্পন্ন হয়েছে বরং শীর্ষ তিনটি পদ সহ প্রায় সকল পদেই ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেল জয়লাভ করেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ডাকসু নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। তারা যে কোনো মূল্যে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে আওয়ামী লীগ যে মিছিল করেছে, সেটিও ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। সে মিছিলে অংশ নেয়া গ্রেফতার হওয়া একজন ইতোমধ্যেই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার নির্দেশনা এসেছে ভারত থেকে। আইজিপির বক্তব্যের বরাত দিয়ে সূত্র জানিয়েছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পতিত অপশক্তি সক্রিয় রয়েছে। এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

একথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগের শাসনের পতন এবং পতন পরবর্তী সৃষ্ট পরিস্থিতি এবার বেশ ভিন্ন মাত্রার। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলের দাবিদার কথিত ঐতিহ্যবাহী দলটির কপালে জুটেছে ফ্যাসিবাদের দুর্নাম। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের এমন লেজেগোবরে অবস্থা কেন হলো? বিষয়টিকে সংশ্লিষ্টরা কীভাবে দেখছেন। এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। মূলত, আওয়ামী সরকারের পতনের এক বছর পূর্তি হয়েছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের চিন্তায়, কথায় ও কর্মে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। অতীত ভুল থেকে শিক্ষা বা অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিতও নেই। এমনকি দলটির নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারেও তাদের কোনো বিকল্প চিন্তা আছে বলে মনে হয় না বরং তারা গণঅভ্যুত্থান ও তাদের সরকারের পতনকে এখনো একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতেই পূলকবোধ করছেন।

এরই মধ্যে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া দলটির কোনো কোনো নেতা অডিও-ভিডিও বক্তব্য ছেড়েছেন সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমে; কেউ কেউ বিবৃতি দিয়েছেন বা এখনো দিচ্ছেন। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার কয়েকটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এ ফোনালাপগুলো থেকে উপলব্ধি করা যায়, তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ সে অশুভ বৃত্তেই রয়ে রয়ে গেছে। এসব ফোনালাপে ক্ষোভ, ক্রোধ ও অনাকাক্সিক্ষত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তবে ক্ষমতা হরিয়ে দলটি যে, ব্যাকফুটে পড়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার নজিরও সৃষ্টি হয়েছে এবার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন হয় গত বছরের ৫ আগস্ট। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে কোনো নির্দেশনাও দিয়ে যাননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। তারা সরকার পতনের খবরে হতবাক ও দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সে পরিস্থিতিতে সারা দেশে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের কাছে তখন জীবন বাঁচানোই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সে পরিস্থিতিতে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় দলের নেতৃত্বের প্রতি তৃণমূলের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, যা সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।

মূলত, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা দলটির নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ পালানোর সময় আটকও হয়েছেন। ফলে তারা এখন রীতিমত বিচারের মুখোমুখি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বেশির ভাগ দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন। গণহত্যা, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটা অংশ। বাদ যাননি আওয়ামী সমর্থিত আমলারাও।

দেশে ও বিদেশে পালিয়ে থাকা দলটির নেতাদের মধ্যে গত এক মাসে বলা যায় একটা যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডলে এখন তাদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছে দেদারছে। এসব ঘটনার মাধ্যমে তাদের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়। আগস্টের মাঝামাঝি ও শেষ দিকে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, দলের এমন নেতাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে শোনা গেছে, মূলত দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা এ উদ্যোগ নিয়েছেন এবং চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা তৈরির চিন্তা তাদের এখনো নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে দলটির অনেক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হচ্ছে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নামে।

ছাত্র আন্দোলন মোকাবেলা করতে প্রথম থেকেই একের পর এক পতিত আওয়ামী লীগ যা করেছে, তার সবই ছিল ভুল বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে এখন তেমনই মনে করেন। তবে দলটি সাম্প্রতিক সময়ে যেসব তৎপরতা চালাচ্ছে সেসব কতটা বাস্তবসম্মত বা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া দলটি প্রাণহানি বা হতাহতের ঘটনার দায়ভার নিতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগ এখনো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তাদের এ কৌশলে যে তাদের ওপর জনমনে আস্থা ফিরে আসবে তা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।

এমনকি দেশের বাইরে থেকে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা কতটা কাজে দেবে, সে প্রশ্নও তাদের মধ্যে রয়েছে। আবার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প নেতৃত্ব দিয়ে দেশের ভেতরে আস্থার সংকট কাটানোর চেষ্টা কতটুকু কাজে দেবে, তা নিয়েও রীতিমত অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পতনের তিন মাস পর আওয়ামী লীগ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে গত ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করেছিলো। অগণতান্ত্রিক শক্তির অপসারণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির কথা বলেছে দলটি। আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিরোধ এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তা সফল হয়নি।

এ কর্মসূচি বিষয়ে আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিলো, প্রথমত এ কর্মসূচি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল এবং জনগণ কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তারা সেটি বুঝতে চেয়েছে। রাজনীতিতে ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় থাকাও ছিল তাদের কর্মসূচির অন্যতম একটি লক্ষ্য। অস্তিত্বের সংকট থেকে আওয়ামী লীগকে বের করে আনতে ও দলকে সংগঠিত করার চেষ্টায় সামনে আরও কর্মসূচি নেয়ার চিন্তাও রয়েছে তাদের।

বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নেতারা দেশের বাস্তবতা কতটা বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচি দিচ্ছেন সে প্রশ্নও তুলেছেন দেশে পালিয়ে থাকা নেতাদের কেউ কেউ। তারা মনে করছেন, এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া অব্যাহত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আরও মামলা হবে এবং তাদের ধরতে অভিযান শুরু হবে। তবে একই সঙ্গে এ নেতারা ঘুরে দাঁড়াতেও চান। কিন্তু তার পথ কী, তা তারা জানেন না।

আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রায় দুু’হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ হাজারের বেশি, যাদের মধ্যে অনেকে চোখ হারিয়েছেন, অনেকে পা হারিয়েছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন কেউ কেউ। স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো আন্দোলনে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের পেছনে এটাই বড় কারণ।

আওয়ামী শাসনামলের দমন-পীড়নে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও ভিন্নমত দাঁড়াতে পারেনি। নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। তাদের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ দেশ চালাত। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল; ভিড় জমেছিল সুবিধাবাদীদের। সরকার পতনের পর এক সময় ছাত্রলীগ করা অনেকেই যখন নিজেদের ভিন্ন মতাদর্শের বলে প্রচার করতে শুরু করেছেন। যা ক্ষমতাচ্যুদের অনেকটাই ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদের পক্ষে রাজনীতির ময়দানে ঘুরে দাঁড়ানো অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বই এখন তাদের শেষ ভরসা।

আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বললে বাস্তবে তারা তা কখনোই বিশ্বাস করতো না বরং তারা ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতারই ধারক ও বাহক। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অশুভ বৃত্তেই তাদের রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব ও তাদের অনুসারীদের হাতে হাউজেই খুন হয়েছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার শাহেদ আলী। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী সরকারের আমলে সিরাজ শিকদার সহ ত্রিশ হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিলো। একই সাথে হত্যা করা হয়েছিলো দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। ফলে তাদেরকে এক দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিলো।

দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর জাতির কাছে অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরও তারা নিজেদের খাসলত বদলাতে পারেনি। ফলে ২০০১ সালে আবারও তাদেরকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নতুন করে ক্ষমতায় এসে অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। দেশকে পরিণত করা হয়েছিলো এক মাফিয়াতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে আওয়ামী বাকশালীরা আবারো ক্ষমতা হারিয়েছে। তারা নানাবিধ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যম আবারও দৃশ্যপটে ফিরে আসার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তবে তাদের সে স্বপ্নবিলাস কখনোই সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ, জনগণ এখন বেশ সচতেন। তাই পতিতদের সকল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিফলে যাবে বলেই সকলের বিশ্বাস।