মো. ফাহিম আলী

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবর্তিত Reciprocal tariff বা পাল্টা শুল্ক নীতি শুধু অর্থনৈতিক প্রভাবই ফেলেনি, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ নীতি দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ভারসাম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণকে নয়া বাস্তবতায় নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য রপ্তানিনির্ভর দেশসমূহের অর্থনীতির জন্য এটি একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশগুলোর জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্য নীতির পুনর্বিন্যাসেরও প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% শুল্ক আরোপের ফলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প একটি প্রতিরক্ষামূলক বাণিজ্য ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে। যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও ব্যাপক কর্মচ্যুতি ঘটাবে বলে আশংকা রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে থাকলেও, মার্কিন বাণিজ্যনীতিতে Economic

nationalism এবং Protectionism -এর প্রতিফলনের ফলে বিশ্বায়ন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে। এ শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করতে পারে, যেখানে বিকল্প বাজার যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (GSP) সুবিধা পাওয়া না গেলে, বাংলাদেশের সাপ্লাই চেইন ভঙ্গুরতা আরও প্রকট হতে পারে।

মার্কিন শুল্কনীতির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের তুলনামূলক কম ২৬% শুল্ক সুবিধা পাওয়া এ অঞ্চলের বাণিজ্যিক ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যা উদীয়মান শক্তি হিসেবে ভারতের জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোয় পুনঃসংগঠন ঘটাতে পারে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও (৪৪% শুল্ক আরোপ) এ নীতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ দেশটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির ফলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্র-চীন কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এছাড়া, চীন নিজেও এ শুল্ক নীতির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কৌশল একদিকে চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মতো বিকল্প শক্তিকে এগিয়ে দিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে চীনের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যেখানে চীন নিজস্ব বাণিজ্য অংশীদারদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করার কৌশল নিতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলার একমাত্র উপায় হলো বহুমুখী বাণিজ্য কূটনীতি গ্রহণ করা। আঞ্চলিক বাণিজ্য সংহতির দিকে লক্ষ্য রেখে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (SAFTA) এশিয়ান ইকোনমিক ফোরাম (AEC) এবং BIMSTEC-এর মতো আঞ্চলিক বাণিজ্য উদ্যোগের মাধ্যমে বাণিজ্য প্রসার করা। সে সাথে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (IPEF) -এ অংশগ্রহণ করে বিকল্প বাণিজ্য অংশীদার খুঁজতে পারে। চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মার্কিন বাজারের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমিয়ে চীনের বিপণন চ্যানেল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে। তাছাড়া পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মার্কিন শুল্কনীতি শুধু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও পরিবর্তন করছে। বাংলাদেশকে এখন কৌশলগত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাণিজ্যিক কূটনীতিতে আরও সক্রিয় হতে হবে। বাণিজ্য যুদ্ধের এমন প্রেক্ষাপটে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার পাশাপাশি কৌশলগত বাণিজ্য অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। যাতে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে টিকে থাকা সম্ভব হয়। লেখক : শিক্ষার্থী।