শহরে বসবাসের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসার পাশাপাশি নির্মল বাতাস বা পরিবেশ প্রাপ্তিও মৌলিক অধিকার। কিন্তু নির্মল বায়ুপ্রাপ্তির অধিকারটা যেন ভুলতেই বসেছে নগরবাসী। কারণ তাদের এ অধিকারের দিকে নজর দিচ্ছে না কেউ। বিশেষ করে জনবহুল নগর ঢাকায় বসবাসকারীরাতো ঠিক কবে নির্মল বায়ুতে শ্বাস গ্রহণ করতে পেরেছিল তা মনেই করতে পারছে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন। ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বাতাসের মান খারাপ ছিল গত ১৪ ডিসেম্বর, যাতে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। অর্থাৎ বায়ুমান সূচক ০-৫০ থাকলে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয় ৫১-১০০ হলে তা সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য ১০১-১৫০ এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১-৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ৩০১ বা তার বেশি এ কিউআই স্কোরকে দুর্যোগপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণে তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের ১২৪টি দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকা ছিল দূষণের দিক থেকে প্রথম। এ দিন ঢাকার বাতাসের বায়ুমান ছিল ২৫০। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা। এ অবস্থায় ঢাকার বাতাস পরিশোধনের জন্য পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিয়ে যদি পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকা পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যথা পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। তবে ওই চিঠি অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী মানুষ গত ৯ বছরে (৩ হাজার ১১৪ দিনের হিসাব) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিতে পেরেছেন। এ সময়ে ৮৫৩ দিনের বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। আর খুব অস্বাস্থ্যকর ও দুর্যোগপূর্ণ বাতাস ছিল যথাক্রমে ৬৩৫ দিন ও ৯৩ দিন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ, গত ৯ বছরে ঢাকার বায়ুমানের সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র এসব তথ্য জানায়। তাতে বলা হয় দেশে প্রতি বছরই বায়ুদূষণ আগের চেয়ে বেড়েছে। আর প্রতিবছর যদি এভাবে বায়ুদূষণ বাড়তেই থাকে আর এর প্রতিকারে যদি কোন পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে পরিস্থিতি কী অবস্থায় গিয়ে ঠেকবে তা কি কল্পনা করা যায়?
আমরা দেখছি ঢাকার বায়ু যতই খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাক না কেন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। তাদের কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। বিভিন্ন মিডিয়াতে রিপোর্ট প্রকাশ হলে দুই এক দিন লোক দেখানো কিছু কাজ করা হলেও পরক্ষণেই সেইসব পদক্ষেপ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কাজের কাজ হয় না কিছুই। আগের মতোই অবস্থা থেকে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে থাকে।
আমরা যদি সম্প্রতি প্রকাশিত আইকিউএয়ারের তথ্য পর্যালোচনা করি; তবে দেখবো বাংলাদেশ একাধিক বছর বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বাতাসের দেশের তালিকায় ছিল। ২০২১ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। সে সঙ্গে গত বছর দূষিত বাতাসের শহরগুলোর বৈশ্বিক তালিকায় রাজধানী ঢাকা ছিল তিন নম্বরে। জেলাভিত্তিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের জেলা গাজীপুর। এ জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষিত বাতাসের জেলা সিলেট। যদিও সিলেট শহরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি। এমনকি এটা বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানের চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।
এর অর্থ হলো বায়ুদূষণ কেবল ঢাকাতেই থেমে নেই। বিষয়টি জেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিল্পবেষ্টিত জেলা গাজীপুরে আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে বায়ু দূষণ। গাজীপুর জেলাতে বন ও পরিবেশ গাছ গাছালিতে পরিবেষ্টিত একটি জেলা। কেবল মাত্র কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে জেলাটিতে।
এবার আসি বায়ুদূষণের কুফলের দিকে। শহরের বাতাসের গুণমান অস্বাস্থ্যকর হয়ে গেলে কঠিন এবং জটিল রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এর মধ্যে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ অন্যতম। এছাড়া কিডনির ওপরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বায়ুদূষণ। রক্তচাপ, প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি, চোখ ও ফুসফুসের সমস্যা, ক্যানসার ও হৃদরোগেরও অন্যতম কারণ হতে পারে বায়ুদূষণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশীদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ুদূষণ-জনিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ একাধিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ফলে কমছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। কঠিন রোগ হতে পারে বায়ুদূষণের কারণে। দূষণের শিকার দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ তারা বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন। ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে ও স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া গর্ভবতীদের শারীরিক ক্ষতির অন্যতম কারণ হলো বায়ুদূষণ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে।
প্রজনন স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে বায়ুদূষণের কারণে। বিশেষজ্ঞদের মত, বায়ুদূষণে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে এমনকি শুক্রাণুর মানও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নারীদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। আবার যেসব ডিম্বাণু আছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যান্সার ও হৃদরোগের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার ও হৃদরোগ হতে পারে। এমনকি সেটি মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। একই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন- ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমাসহ নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
আমরা দেখছি শহরে যত জটিল রোগের আবির্ভাব সবগুলোর পেছনে বায়ুদূষণ অন্যতম ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে বলে গবেষণায় প্রতিফলিত হচ্ছে। সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে পরিবেশে এবং বাতাসের এমন ক্ষতি করছি যাতে সামগ্রিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য আমাদের নিজেদের যেমন সচেতন হতে হবে; তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। তাহলেই নগরবাসী নিস্তার পাবে অভিশপ্ত বায়ু দূষণ থেকে।
লেখক : সাংবাদিক।