মুসফিকা আন্জুম নাবা
আমাদের দেশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে উৎপাদিত মাদকের অবাধ বাজারে পরিণত হয়েছে। ফলে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের যুব সমাজ। অবক্ষয় এখন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। স্থানীয়ভাবে মাদক উৎপাদন খুব একটা না হলে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে বানের পানির মত ভেসে আসা বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারের তলানীতে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, একশ্রেণির প্রভাবশালী ও উচ্চবিত্তের লোকেরাই মাদক ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। কতিপয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধেও এ অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার জোরালো রয়েছে। আরো অভিযোগ রয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যও অর্থের বিনিময়ে মাদক ব্যবসাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে দেশে কঠোর আইন থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই সহজসাধ্য হচ্ছে না। এমনকি দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থাকলেও তা কোনভাবেই সফল হতে পারছে না। ফলে পুরো দেশই এখন মাদকের বাজারে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত, মাদক হলো এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা পরিবর্তন ও নেশা, আসক্তি এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আইনিভাবে নিয়ন্ত্রিত ওষুধ ছাড়াও, গাঁজা, হেরোইন, অ্যাম্ফেটামিন, কোকেন, তামাক, অ্যালকোহল ইত্যাদিও মাদকের অন্তর্ভুক্ত। মূলত, মাদকদ্রব্য বলতে এমন বস্তুসমূহকে বুঝায়, যেগুলো শরীরে প্রবেশ করলে কিছু স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক হয় এবং বারবার এসব দ্রব্য গ্রহণে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। নেশাদায়ক পদার্থের মধ্যে নিকোটিন, মরফিন, হেরোইন, এলএসডি, কোকেইন প্রভৃতি প্রধান। মাদক জাতীয় পদার্থগুলো স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যাহত করে। ফলে মানবদেহে নানা ধরনের ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। যার ফলাফল দাঁড়ায় জীবনীশক্তির বিপর্যয় ও অকালমৃত্যু।
মাদকদ্রব্য সেবন যখন কোন ব্যক্তির নেশায় পরিণত হয়, তখন তা একসময় তার মানসিক ও শারীরিক নির্ভরতার অবলম্বনে পরিণত হয়। নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি ক্রমাগত আকর্ষণ বৃদ্ধি হয়। দিন দিন মাদকদ্রব্য গ্রহণের ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। একই সাথে বাড়তে থাকে সময় ও মাত্রা। মাদকসেবীর সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়া নেশা। চেনা মানুষটিও এর ক্ষতিকর প্রভাবে বদলে যায়। দিনদিন জীবনের সব ধরনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। রাত কাটে নির্ঘুম। জীবনযাপনে দেখা যায় উচ্ছৃঙ্খলতা। জীবনে নেমে আসে বিষন্নতা ও হতাশা। সামাজিক মানুষটিও আস্তে আস্তে অসামাজিক হয়ে উঠে। কোন অবস্থাতেই নিজেকে সন্তুষ্ট ভাবতে পারেনা। এক অস্বাভাবিক অতৃপ্তি থাকে চোখেমুখে, মাদক সেবন বন্ধ করলে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নেশার টাকার জন্য যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় খুন-খারাবীও করে ফেলে। এ অবস্থাকেই মাদকাসক্তি বলে। যা এখন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশে জাতীয় জীবনকেই দুর্বিষহ করে তুলেছে।
মূলত, মাদকাসক্তি ভয়াবহ মরণব্যাধি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে সকল সমস্যা বিদ্যমান তার একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মাদকের ভয়াল থাবা। দেশে দিন দিন মাদকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাদকের কেনাবেচা হয় না। শহর থেকে শুরু করে গ্রামেও এটি সহজলভ্য। গ্রামের মুদির দোকানে এখন মাদক খুবই সহজলভ্য।
আমাদের দেশে প্রচলিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ, আফিম, হেরোইন, কোকেন, প্যাথেডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠাও রয়েছে। এসব ভয়ানক নেশা জাতীয় দ্রব্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। এসব মাদকের বেশির ভাগই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার হতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছেন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শত শত নদ-নদী দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্র উপকূল ও জলপথকে তাদের পণ্য পাচারের খুবই উপযুক্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করেন। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মাদকের রুট।
আমাদের যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত। দিনদিন যুবসমাজের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এমনকি তা এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী। বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।
মাদক সেবনে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয়প্রকার ক্ষতিসাধন হয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে। এসব জীবন বিধ্বংসী ক্ষতিকারক দ্রব্য সেবনের ফলে যুবসমাজের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। এরই পরিণাম স্বরূপ ছেলেমেয়ের হাতে মা-বাবা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি এখনকার নৈমিত্তিক ঘটনা।
বস্তুত, মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। এ ছাড়াও পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা ইত্যাদি কারণেও যুবসমাজ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদক পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ও শৈশব থেকে তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবেরূপ দিতে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে আজকে মাদক গ্রাস করে ফেলেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চললেও অভিযান চালানো হয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরাপদে মাদক গ্রহণের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হচ্ছে।
অনেক বহিরাগত নিরাপদে মাদক সেবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ভিড় করে। ক্যাম্পাসে অবাধে মাদকের বিচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীকে মাদক সেবনের প্রতি প্রভাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মাদকের বিস্তার রোধ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি হলে পরামর্শদাতা নিয়োগ দিতে হবে এবং প্রতিবছর ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন কয়েক দফায় এ ডোপ টেস্ট হতে পারে।
মাদকের ভয়াবহ দংশন থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। এ ছাড়াও দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং মাদক চোরাচালানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে থেকে তারা তাদের বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা। স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
মাদক নিয়ে নানা ধরনের কথায় বাজারে প্রচলিত আছে। ক্ষেত্র বিশেষে মাদকের পরিমিত ব্যবহারের আবাশ্যকতাও রয়েছে। কিন্তু অপব্যবহার কোনভাবেই কাম্য নয়। বস্তুত, সর্বজনীন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও অপরাধের বিচার সংক্রান্ত প্রসঙ্গে মাদক সেবনের বিভিন্ন প্রকারের বিসদৃশ সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে, মানুষ যখন মাদকের প্রভাবের অধীনে থাকে তখন অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী আচরণ সংঘটিত হয় এবং মানুষদের মধ্যে দীর্ঘকালীন ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনও ঘটতে পারে। সম্ভাব্য শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি ছাড়াও, কিছু মাদক ব্যবহারের ফলস্বরূপ ফৌজদারী জরিমানাও হতে পারে।
মাদক শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয় বরং বৈশ্বিক সমস্যা। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এর ব্যাপক অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এমনকি সেসব দেশে মাদকের অপব্যবহার ও সেবন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে যা তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু এ শুভ বৃত্ত থেকে তারা কোন ভাবেই বেড়িয়ে আসতে পারছে না বরং দিনের পর দিন সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এক বৈশ্বিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে প্রায় ৫% মানুষ (২৩০ মিলিয়ন) একটি বেআইনি নেশার জিনিস ব্যবহার করেছিল। এর মধ্যে ২৭ মিলিয়ন মানুষ উচ্চ-ঝুঁকিসম্পন্ন মাদক ব্যবহার করেছিল যা অন্যভাবে পর্যাবৃত্ত মাদক সেবন নামেও পরিচিত এবং এর কারণে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি, মানসিক সমস্যা, বা সামাজিক সমস্যাগুলি দেখা দেয় যা তাদেরকে এ বিপদগুলির মুখে ফেলে। মাদকদ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যাধির ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালে ১৬৫,০০০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৩০৭,৪০০টিতে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা হল মদের নেশা সংক্রান্ত ব্যাধির কারণে ১,৩৭,৫০০টি, ওপয়েড ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যাধির কারণে ১,২২,১০০টি মৃত্যু, অ্যাম্ফেটামাইন ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যাধির কারণে ১২,২০০টি মৃত্যু এবং কোকেন ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যাধির কারণে ১১, ১০০টি মৃত্যু।
আমাদের দেশের আর্ত-সামাজিক প্রেক্ষপটে মাদকদ্রব্য ও মাদকসেবীরা আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে রীতিমত বিষিয়ে তুলেছে। বিপর্যয় নেমে এসেছে সামাজিক জীবনেও। এমতাবস্থায় দেশ ও জাতিকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের হালনাগাদও করা জরুরি। যুব সমাজের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং ব্যাপকভিত্তিক গণসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে অন্যথায় নতুন প্রজন্মকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে কোনভাবেই রক্ষা করা যাবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট।