মহাবিশ্বের ছোট্ট একটা গ্রহ আমাদের এ পৃথিবী। ছোট্ট হলে কী হবে, খুবই সুন্দর এ পৃথিবী। মহান স্রষ্টা মানববান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন আমাদের ধরিত্রীকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা ধরিত্রীর বান্ধব হতে পারিনি। ধরিত্রীর প্রতি আমাদের আচরণ খুবই নেতিবাচক। মানুষের প্রতি মানুষের আচরণও ভালো নয়। আচরণ অতিশয় মন্দ হওয়ার কারণেই তো দু’টি বিশ^যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বর্তমান বিশ^ব্যবস্থায় তো অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শংকা প্রকাশ করছেন। এবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে সে শংকা যেন ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। তবে আশার কথা, সে যুদ্ধে বিরতি ঘটেছে। ১০ মে শনিবার সন্ধ্যায় মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এখন গণমাধ্যমে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যুদ্ধের পর্যালোচনা, হার-জিতের চিত্রও অঙ্কিত হচ্ছে। যুদ্ধিবিরতির পর পাকিস্তান জুড়ে শুরু হয়েছে আনন্দ-উৎসব। রোববারকে ‘ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা’ জানানোর দিন ঘোষণা করেছে পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে তাদের বিজয়ী বীর সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ দিয়েছেন বিজয় ভাষণ। বিপরীতে পরাজয়ের গ্লানিতে মলিন হয়েছে ভারত। আর প্রচণ্ড চাপের মুখে নরেন্দ্র মোদির কপালে বাড়ছে হতাশার কুঞ্চনরেখা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনার আগে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দাঁড়িয়েছিল মোদি সরকারের পাশে। এখন তারাই এ সরকারকে দাঁড় করাচ্ছে কাঠগড়ায়। প্রশ্ন করছে, এমনটি কেন হলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। পাকিস্তানে যখন বিজয়ের আবহ, তখন করণীয় ঠিক করতে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠকে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, অভাবিত পরাজয়ের দুঃখে ওরা এখন বড়ই কাতর। আসলে বাড়াবাড়ির ফল কখোনাই ভালো হয় না।
ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ফলাফল এবং যুদ্ধবিরতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছে। এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী চিঠি দিয়েছেন সংসদ নেতা নরেন্দ্র মোদিকে। এদিকে শিবসেনাসহ অন্যান্য কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি ভারতের ক্ষুব্ধ জনগণ মোদি সরকারকে ‘গাদ্দার’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগের দাবি তুলেছে। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি এবং কাশ্মীরকে নতুন করে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের অনেক নীতিনির্ধারক। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে মার্কিন মধ্যস্থতা কীভাবে মেনে নিল মোদি সরকার? পর্যবেক্ষকদের মনে প্রশ্ন, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারত কি এমন কোনো বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিল, যাতে মার্কিন মধ্যস্থতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল? রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদিকে প্রদত্ত চিঠিতে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে বলেছেন, যুদ্ধবিরতি ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে অবশ্যই সংসদের বিশেষ অধিবেশন জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে শিবসেনার প্রভাবশালী নেতা সঞ্জয় রাউত মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ভারতের মাটিতে ভারতের হিন্দুরা মারা গেল, তার বিরুদ্ধে সরকার কী করলো? মোদি সরকার এতই দুর্বল যে, আমেরিকাকে শেষ পর্যন্ত ডেকে আনতে হলো। মোদি সরকার অপারেশন সিঁদুরের নামে আমাদের মা-বোনদের সিঁদুরকে অপমান করেছে। আমাদের জওয়ানদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। দেশের সঙ্গে রীতিমত গাদ্দারি করেছে মোদি সরকার। হিন্দু সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়েছে। সঞ্জয় রাউত আরো বলেন, আমরা তো বদলা নিতে চেয়েছিলাম। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম আমাদের সৈন্যরা করাচি, লাহোর এবং পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে হামলা করছে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম! সরকার কি বদলা নিতে পেরেছে? অমিত শাহের সে হুংকার এখন কোথায়? আমরা এ গাদ্দারদের পদত্যাগ চাই।
পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, এক হঠকারী যুদ্ধ শুরু করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ভারত। অপারেশন সিঁদুরের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক জবাবে রাফায়েলসহ পাঁচটি যুদ্ধবিমান হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে ভারত। এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা ভারতের ধারণায়ও ছিল না। আর এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানের আসল প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। অবশেষে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েই শুরু করে অপারেশন ‘বুনিয়ানুম মারসুস’। এটি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অংশবিশেষ, যার অর্থ ‘সিসাঢালা প্রাচীর’। এ অপারেশনে শতশত ড্রোন আর মিসাইল দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে অবিরত হামলা চালায় পাকিস্তান। এ হামলায় বিপর্যস্ত হয় ভারত। ৫০ জনের বেশি সৈন্য হারানোর পাশাপাশি ধ্বংস হয় অনেকগুলো সামরিক পোস্ট। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে ঠিক কী করবে, সে সিদ্ধান্তই নিতে পারছিলেন না ভারতের নীতিনির্ধারকেরা। অবশেষে কারগিল যুদ্ধে মতো এবারও ভারতের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি। শুধু এবার নয়, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধেও নাস্তানাবুদ হয়েছিল ভারত। সে সময়ও একটি যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্না দিয়েছিল ভারত। এবার যে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো, তা মোদির ভারতের জন্য মোটেও সুখকর স্মৃতি হিসেবে বিবেচিত হবে না। ভারতের নিরাপত্তা নীতি ও যুদ্ধকৌশল এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। খোদ ভারতীয় সমরবিদরাও প্রশ্ন তুলছেন। অপারেশন সিঁদুর নিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি বিশ্লেষণধর্মী ভিডিও প্রকাশ করেছেন ভারতের বিশিষ্ট সমরবিদ এবং ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রভিন সনি। ওই ভিডিও আলোচনায় তিনি শুধু সামরিক অভিযানের বিশ্লেষণ নয়, ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা নীতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ওই বিশ্লেষণ পছন্দ হয়নি ভারতের বর্তমান কর্তৃপক্ষের, তাই ভারতে ওই ভিডিও ব্লক করে দেয়া হয়।
এবার পাকিস্তানের গণমাধ্যমের বিশ্লেষণের ওপর আলোকপাত করা যায়। ডন জানায়, ভারতের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল হামলার পর থেকেই সঙ্কট শুরু হয়। ভারত কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গীদের ওপর এ হামলার দোষ চাপিয়ে দেয়। এরপর ইসলামাবাদের নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান উপক্ষো করা হয়। নয়াদিল্লী সচেতনভাবে উত্তেজনা বাড়িয়ে ৭ মে থেকে পাকিস্তানের ভূখ-ে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালায়। সবচাইতে তীব্র সংঘর্ষ ঘটে ৯ এবং ১০ মে, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। এর একটি ছিল, যখন ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চায়। এরপর পাকিস্তানের কাছ থেকে দ্রুত এবং কৌশলগত প্রতিশোধের মুখোমুখি হয় ভারত। সমগ্র সংকটের সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রতিক্রিয়া ছিল পরিমিত এবং নিষ্পত্তিমূলক। ভারতের অপারেশন সিঁদুরের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের বাহিনী ৭ মে চীনের সরবরাহকৃত জে-১০ সি যুদ্ধবিমান এবং পিএল-১৫ই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাফায়েলসহ পাঁচটি ভারতীয় জেটবিমান ভূপাতিত করে, যা ছিল আকাশে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির ওপর বড় আঘাত। এরপর ১০ মে একটি বিরল এবং সুপরিকল্পিত পদক্ষেপে পাকিস্তান জেএফ-১৭ থেকে ছোড়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতীয় এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল সীমান্তের ওপারে নয়, বিশ^জুড়ে একটি কড়া বার্তা পাঠিয়েছে। এই বিপর্যয়ের ভারে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাক্সক্ষা, যা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক কৌশলের ভিত্তি ছিল তা ভেঙে পড়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা খাতকে আধুনিকীকরণের অন্যতম অস্ত্র রাফায়েল ও এস-৪০০ এখন তাদের পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বহু বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো পাকিস্তান কেবল সমতাই প্রদর্শন করেনি, বরং ভারতীয় সামরিক প্রাধান্যের দাবিকে দুর্বল করে প্রতিরোধমূলক বিশ^াসযোগ্যতা প্রদর্শন করেছে।
কূটনৈতিকভাবেও পরিস্থিতি উল্টে গেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী যখন গুরুতরভাবে আক্রান্ত হলো এবং বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ের দিকে পৌঁছে যাচ্ছিল, তখন ওয়াশিংটন তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়, যা ভারতের মেনে নেয়ার কথা ছিল না, অথচ আপন গরজেই ভারত তা মেনে নেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যারা এ সংকট নিরসনে সাহায্য করেছে, তাদের এখন ভারতের কাছে জবাবদিহি চাইতে হবে বলে মনে করেন পাকিস্তানের বিশ্লেষকরা। এছাড়া সংলাপ বাস্তবসম্মত হতে হবে, বাকপটুতাপূর্ণ নয়। ভারতকে দেখাতে হবে যে, তারা শান্তিকে বেশি মূল্য দেয়। পাক বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশে পাকিস্তান এবারের লড়াইয়ে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে, যে চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি। পাশাপাশি তার প্রতিপক্ষের ভুল হিসাব প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে, কূটনৈতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করেছে এবং আঞ্চলিক আখ্যানকে দিয়েছে নতুন রূপ। এই বিশ্লেষণ ভারতীয়দের মেনে নেয়া কঠিন। তবে আমরা মনে করি, ভারত যুদ্ধে হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছে, আর আক্রান্ত পাকিস্তান পরিচয় দিয়েছে শক্তিমত্তার।