অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সকল জেলা প্রশাসক নিয়ে তিনদিনব্যাপী কনফারেন্সের উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে ডিসি তথা আমলাদের প্রতি একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো, সামনে যেন দুর্নীতি না হয়, এ বিষয়ে ডিসিদের জিরো টলারেন্স দেখানোর বিষয়ে সতর্কতা ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পতিত সরকারে আমলে পাতানো নির্বাচন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক বড় ধরনের ভূমিকার কারণে ইতোমধ্যে ৭৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে ৪৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের বেশি তাদের মধ্যে ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিসিদের মতো পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলার কথা বলেছেন ধর্মউপদেষ্টা। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮, ও ২০২৪ এর বিতর্কিত নির্বাচনে যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে ন্যক্কারজনক নানা ধরনের দুর্নীতি করে নিজেরা ফায়দা লুটে নিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক দাখিলকৃত প্রতিবেদনের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে দেশের জনপ্রশাসন। এ সিদ্ধান্তকে দেশের সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের তরুণ যোদ্ধারা অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শুভ লক্ষণ বলে আশা ব্যক্ত করেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা শুনে শুনে এক পর্যায়ে তা সহ্য হয়ে গিয়েছে। বিগত দিনে দেশে আমলাদের অনিয়ম -দুর্নীতি, শোষণের মাত্রা যেন ব্রিটিশ শাসন আমলকেও হার মানিয়েছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা কর্তৃক গত ৫ আগস্টের বিপ্লবকে কেন্দ্রকরে দেশের শহর, নগর থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের সকল নিপীড়িত-বঞ্চিত নাগরিক ও মেহনতি মানুষের মধ্যে নতুন আমেজে বৈষম্যবিরোধী চেতনায় জাগ্রত হয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে ৬০ হাজার মানুষ খুন করার খবর বেড়িয়েছে দেশের জাতীয় দৈনিকে। বিশেষ করে ৯ ডিসেম্বর ২০১২ সালে বিশ্বজিৎদাস, ৬ অক্টোবর ২০১৯ আবরার ফাহাদ ও ২৭ এপ্রিল ২০১৪ চন্দনসহ ৭ জন হত্যাকাণ্ডের আলোচিত ঘটনা এবং সর্বশেষ জুলাই আগস্টের গণহত্যার বিষয়টি দেশ ও বিশ্বের দরবারে বিশেষ করে সম্প্রতি জাতিসংঘের বিবৃতির বিশ্ব মানবাধিকার অঙ্গনে মুখ্য আলোচনায় উঠে এসেছে।

গণতন্ত্র হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ারের নামে খুন, গুম, হামলা, মামলা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নীপিড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যে মিশন পার্শবর্তী দেশ ভারত শেখ হাসিনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল তা অধিকাংশ পালনের কারণেই তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়ে দিনাতিপাত করতে পারছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। পিলখানার সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাযজ্ঞ, প্রহসনের বিচারে জাতীয় নেতাদের জেল, জুলুম, হুলিয়া, ফাঁসীসহ নানা উপায় অবলম্বন করে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, আয়না ঘরে লোমহর্ষক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সত্যতা বিশ্ব বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে।

একটি দেশকে বিনা যুদ্ধে ধ্বংস করতে যে তিনটি বিষয় প্রয়োজন পড়ে তার সবগুলোই বাস্তবায়ন করেছে পতিত সরকার। এক: নদী ও পানির অধিকার হরণ করে দেশকে মরূকরণ করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা। দুই: মাদকের অবাধ সয়লাব ঘটিয়ে তরুণ ও ছাত্রসমাজের কর্মক্ষম শরীর-স্বাস্থ্য ও মেধা ধ্বংস করা। তিন: পশ্চিমাবিশ্ব তথা ভিনদেশের অপসংস্কৃতি প্রথা ও অপশিক্ষামূলক কারিকুলাম তৈরী করে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদিয়ে জাতিকে মেধাশূন্য ও চরিত্র ধ্বংস করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার অপকৌশল অবলম্বন করা। আমার মনে হয় বিগত ৫০ বছরে এর প্রায় সবগুলোই এদেশে ইতোমধ্যে অতিসহজ উপায়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।

আশার কথা হলো, ‘জাল যার জলা তার, দলিল যার জমি তার’ এ বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনায় সর্বস্তরের গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নড়েচড়ে বসেছে বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসন। ইতোমধ্যে প্রজাতন্ত্রের নাগরিক কর্তৃক আমলাদের স্যার বলে সম্বোধনের বিষয়টি জনপ্রশাসন ফয়সালা করে দিলেও তা আদতে সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন আমলারা এখনও দাপটের সাথে তাদের কক্ষের দরজা বন্ধ করেই অফিস করেন। সচিবালয়ে প্রবেশের নানাবিধ প্রক্রিয়ার কারণে সাধারণ জনগণ সেখানে অবাধে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনাদিকাল থেকে। বিভাগ, জেলা, উপজেলায় সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত অফিস আদালতসমূহের কক্ষে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ কর্মকর্তার কার্যালয়ের দরজা বন্ধ থাকে।

দাপ্তরিক কাজে আসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে শুরু করে সকল প্রকার অধস্তন কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের অফিসকক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পিওনদের নিকট অনুনয়-বিনয় প্রদর্শন করেও পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি। গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে এটা বেমানান হলেও এটা প্রচলিত প্রথা হিসেবে আমাদের সহ্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। এ অবস্থা শুধু সরকারী-অফিস আদালতে নয় বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল দফতরে এমন কি পৌরসভার মেয়র-কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কক্ষের দরজাও বন্ধ থাকে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নিকট দরজা বন্ধের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, বলা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে আরামে অফিস করার জন্য দরজা বন্ধ রাখা হয়।

রাষ্ট্রের কর্মদিবসে সরকারি অফিস কক্ষে দরজা সার্বক্ষণিকভাবে বন্ধ রাখার যে প্রথা চালু করা হয়েছে, এ ব্যাপারে দেশের সংবিধানে কোন সুনির্দিষ্ট আইন আছে বলে আমার জানা নেই। কড়াকড়িভাবে অফিস কক্ষের দরজা বন্ধের রেওয়াজ ব্রিটিশ ঊপনিবেশের আমলেও লক্ষ্য করা যায়নি। অথচ এ বিষয়টি নিয়ে দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এমন কী জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ কোথাও উ”চবাচ্য বা প্রতিবাদ করেছেন বলে আমার জানা নেই।

শোনা যাচ্ছে, পতিত সরকারের বৈষম্য ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের সকলকে শহীদের মর্যাদাদানসহ তাদের পরিবারকে মাসিক ভাতা প্রদান করা হবে। সাংবাদিকতায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে একাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে ডিগ্রী বা সমমানের শিক্ষাযোগ্যতা থাকতে হবে মর্মে যে আভাষ পাওয়া যাচ্ছে তা কবে নাগাদ কার্যকর করা হবে এ প্রশ্ন জনগণের। সরকার বলছে, শিক্ষার কারিকুলাম ঢেলে সাজানো হবে, প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হবে, মসজিদের ইমাম -মুয়াজ্জিনদের মাসিক সম্মানি দেয়া হবে, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করা হবে , মুজিবের উপর লেখা অপাঠ্য সব বই ধ্বংস করবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইত্যাদি।

একই সাথে দেশের একশ্রেণির শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, অভিজ্ঞমহল, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন আমলাদের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময় ও আলোচনায় মিলিত হই। বিষয়টি হলো, জনপ্রশাসনের আমলাদের মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণতা প্রশমনে তাদের মনের জমিনে বিবেকের ফসল ফলাতে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ জাগ্রত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং তাদের ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে, সৎ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী আমলাদের অসাধারণ কৃতকর্মের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের ও তাদের পরিবারের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধির নিমিত্ত প্রণোদনা বৃদ্ধিমূলক ‘জনপ্রশাসন পদক’ চালু করার বিষয়ে সরকারে নিকট আবেদন করছি। যেমনটা, দেশ সেবায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর সেরাদের মাঝে স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রদান করা হয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায়ের অধিকাংশ নাগরিকরাই এ প্রস্তাবের স্বপক্ষে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। সে প্রেক্ষিতে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণ ও টেকসই উন্নয়ন স্বার্থ বিবেচনা করে বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সকল উপদেষ্টা ও ঊর্ধ্বতন সংশ্লিষ্ট মহলের নিকট, দেশবাসীর পক্ষ থেকে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুযোগ ও পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে অনতিবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। কারণ আমলারাও এ দেশেরই প্রথম শ্রেণির প্রশাসনিক প্রশাসক হিসেবে নানাবিধ ঝুঁকি নিয়েই তারা দেশের জনগণের সেবা ও নিরাপত্তায় অসাধারণ ভূমিকা রেখে থাকেন। এটি বিবেচনা করেই তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়াতে ‘জনপ্রশাসন পদক’ চালু করা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে সহায়ক হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী