আজকের শিশুরাই আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। তারাই গোটা জাতি ও বিশ্ব নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ রূপকার। শিশু মানেই নির্মল পবিত্র ও নিষ্পাপ আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। শিশুরা বিশ্ব পরিচালনায় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা আকর্ষণীয় প্রতিভার সম্ভাবনার প্রতীক। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই লুকায়িত থাকে সম্ভাবনাময় সুপ্ত প্রতিভা। তাদেরকে সে প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে উদ্ভাসিত হবে পৃথিবী। এক্ষেত্রে মাতা-পিতা এবং শিক্ষকদের সমন্বিত ভূমিকাসমূহ আলোচনা করা হলো।
শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে : আজকের শিশুরা কোমলপ্রাণ হৃদয়ের অধিকারী হলেও আগামী দিনের পরিণত মানুষ। তারাই অগ্রজদের স্বপ্নের ইনহ্যারিটেন্স। আজকে যারা কোমলমতি শিশু তারাই একদিন খ্যাতিমান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। তাদের মধ্যে কেউ হবে শিক্ষক, অধ্যাপক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, দার্শনিক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। শিশুরা শুধু পিতা-মাতার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বরং তারা দেশ ও জাতির সম্পদ। সুতরাং শিশুর সুন্দর ও সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করতে পারলে দেশ ও জাতির ওপর তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব প্রতিফলিত হবে। ইংরেজ কবি Wordsworth যথার্থই বলেছেন; “Children’s are the father of future nations of the world.” অর্থাৎ শিশুরা ভবিষ্যৎ জাতির পিতা। ’একজন যোগ্য পিতা ব্যতীত যেমন একটি পরিবার কল্পনা করা যায় না, তেমনি শিশুদের বিকাশ ও তাদের অধিকার বাস্তবায়ন ব্যতীত গোটা পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব।
শিশুদের সৃজনশীলতায় উৎসাহিত করা : শিশুর বিকাশ ও কল্যাণের মাধ্যমে আজকের বিশ্ব হয়ে উঠবে সুন্দর সার্থক ও প্রশান্তিময়। সাধারণত আমরা সকলেই শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ বলতে শুধু তার শরীরের বৃদ্ধিকেই বুঝে থাকি। কিন্তু তার মানসিক, সামাজিক, আবৈগিক, নৈতিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণ বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য খাদ্য-খাবার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি, সঠিক বন্ধু নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়া ও সৃজনশীল কর্মে উৎসাহিত করা মাতা-পিতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া : শিশুর মানসিকতা, বুদ্ধিমত্তা, কথা বলা ও অন্যদের সাথে যোগাযোগ, উত্তম আচরণ, আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া, নৈতিকতা, ত্যাগের মানসিকতা তৈরি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভীতি সঞ্চারের মানসিকতা ইত্যাদি সকল দিকে তার বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই শুধু বই-পুস্তকের প্রতি নির্ভরশীলতা নয়। শিশুর সামনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উন্নত জীবন যাপনের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে হবে। বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবন ও সাফল্যের কাহিনী তুলে ধরতে হবে। অন্যের মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেয়া, অন্যকে শ্রদ্ধা করার বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও তাঁর আনীত আদর্শ সম্পর্কে শিশুদেরকে শিক্ষা দেয়া মাতা-পিতা ও শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব।
উত্তম আচরণ ও সততার শিক্ষা দান : শিশুর সার্বিক বিকাশে মাতা-পিতার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সেটি হচ্ছে উত্তম আচরণ ও সততার শিক্ষা দান। এজন্য মাতা-পিতাকে শিশুর সাথে নিয়মিত যে কাজগুলো করতে হবে তা হচ্ছে- ১. শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দেয়া ২. যথেষ্ট আদর-যতœ ও ভালোবাসা দেয়া ৩. শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা ৪. ধৈর্যের সাথে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া ৫. তার ভালো কাজের প্রশংসা করা ৬. বিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে তার সাথে কথা বলা ৭. তার বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া ৮. শিশুর সাথে সর্বদা সত্য কথা বলা এবং বিকাশে মাতা-পিতাকে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। ৯. শিশুর নিয়মিত ও সময়মত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ১০. শিশুর সাথে খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে-যাতে তারা তাদের মনের চাহিদা সম্পর্কে বলতে ভয় না পায় ১১. শিশুকে বাড়িতে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ে শোনানো এবং শিখানোর ব্যবস্থা করা ১২. সম্ভব হলে বাড়ির আঙ্গিনায় খেলার জায়গা রাখা ১৩. শিশুর সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় এমন কাজ করা ১৪. বিভিন্ন বিষয়ে শিশুর মতামত শোনা ১৫. সর্বোপরি শিশুর সাথে উত্তম আচরণ করা মাতা-পিতার অপরিহার্য কাজ।
শিশুর চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করা : চরিত্র হচ্ছে মানব জীবনের দর্পণস্বরূপ। তাই শিশুদের চরিত্র গঠনে শুধু মাতা নন, পিতার ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব ক্ষেত্রে মায়ের পাশাপাশি বাবাও শিশুর মানসিক বিকাশে বুদ্ধি বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, সেসব ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ অনেক গতিশীলতা পেয়েছে। “যুক্তরাষ্ট্রের মারটিনবিল বিশ্ববদ্যালয়ের গবেষক প্রফেসর ড. পিটার বন্ড- এর নেতৃত্বে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মাতা-পিতা যৌথভাবে সন্তানদের বিকাশের জন্য কাজ করেন, তাদের সন্তানেরা বেশি বুদ্ধিমান ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে”। সুতরাং মায়ের পাশাপাশি বাবাকেও শিশুর লালন-পালন ও চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে।
কৌতূহলী মনোভাব জাগ্রত করা : শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। মা-বাবা এবং অগ্রজরা অনেক সময় শিশুর হাজারো প্রশ্নে বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করেন। এটা কোনোভাবেই সঙ্গত নয়। শিশুদেরকে তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে। তাদেরকে অনুসন্ধান, যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ দিতে হবে। শিশুদের শিখন পদ্ধতি হতে হবে শক্তিশালী উপায়ে এবং ব্যবহারিক পন্থায়। তার চারপাশের পরিবেশ অন্যরা কিভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা শিখার সুযোগ দিতে হবে। শিশুদের সামনে এমন কিছু করা উচিত নয় যা দেখে তারা নেতিবাচক কিছু শেখে।
শিক্ষকদের ভূমিকা : শিশুর বিকাশে মাতা-পিতার পাশাপাশি শিক্ষকদের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক ছাড়া শিশুর বিকাশ সাধন সম্ভব নয়। পরিশীলিত মানুষ তৈরি করার মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অর্থ হলো নি¤œতর স্তর থেকে উন্নততর স্তরে গমন করা। শিক্ষকগণ হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিশুকে একজন শিক্ষক নি¤œতর স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে উপনীত করার মাধ্যম হিসেব কাজ করে থাকেন। শিশুকে পরিশীলিতভাবে মানুষ তৈরির কাজে এবং প্রকৃত বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারেন। সকল শিক্ষা যদি পারিবারিক পর্যায়ে গ্রহণ করা সম্ভব হতো, তাহলে সারা বিশ্বে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই শিশুরা শিক্ষকদের থেকেই বিকশিত হবে। শিক্ষকগণ হচ্ছেন দেশ ও জাতির আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। সুতরাং শিশুদের মানসিক বিকাশে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উৎসাহ প্রদান : শিশুরা জোৎস্না প্লাবিত নক্ষত্র থেকে আরো আলোকিত হবে, বিকশিত হবে। শিক্ষকগণ যা জানেন, তা শিখাতে কখনো কার্পণ্য করেন না। এটিই তাদের জীবনের বড় সার্থকতা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবৈগিক বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে প্রতিটা স্তরের শিক্ষকদের অবদান অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, বিজ্ঞান মনস্কতায় উজ্জীবিত করা, উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উৎসাহিত করা, সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকদের মহান দায়িত্ব। তবে শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সরকারসহ সকলকে এগিয়ে আসা জরুরি।
শিক্ষকদের জন্য অর্জনীয় : শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিকশিত করা। এজন্য নিজেদেরকে আগে বিকশিত হতে হবে। শিক্ষককে হতে হবে মেধাবী, সুশিক্ষিত, সুদক্ষ, কর্মঠ, ধার্মিক ও সৎ। তাদের উচিত বাণিজ্যক চিন্তা পরিহার করা। এসব গুণাবলী ছাড়া একজন লোক প্রকৃত শিক্ষক হতে পারেন না। আর প্রকৃত গুণের শিক্ষক ছাড়া শিশুরা বিকশিত হতে পারবে না। একজন শিক্ষক মেধাবী হলে ছাত্রও মেধাবী হবে, একজন শিক্ষক সুদক্ষ, সৎ ও মহৎ হলে ছাত্রও সুদক্ষ, সৎ ও মহৎ হবে। এক কথায় শিক্ষক হচ্ছেন শিশুর বিকাশের অনন্য চাবিকাঠি। শিক্ষকদের থেকেই শিশুরা উন্নত জীবন গঠনের প্রকৃত দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকে। কবির ভাষায়, আদর্শ মানুষ জন্ম দেয় আমাদের বিদ্যালয়।’ আদর্শ মানুষ সোনার মানুষ হতে হলে জীবনকে বিকশিত করতে হলে বিদ্যালয়ে যেতে হবে, শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করতে হবে।
সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান : একজন শিশুর বিকাশে মাতা-পিতা যেসব পদ্ধতি উপস্থাপন করতে পারেন, তার চেয়ে বেশি চমকপ্রদ ও মূল্যবান পদ্ধতি উপস্থাপন করতে পারেন একজন শিক্ষক। শিক্ষকদের চাইতে কোনো কোনো মাতা-পিতা উচ্চ শিক্ষিত হলেও শিশুরা শিক্ষককে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তাকে অধিক সম্মান করে থাকে। সকল ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ মাতা-পিতার দ্বারা করা সম্ভব হয় না। সেসব ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয় একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমেই। তাই বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিশুর প্রতি শিক্ষকদের সমানভাবে আন্তরিক হওয়া ও গুরুত্ব দেয়া উচিত। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে হয় না। ফলে বৈষম্যের কারণে শিশুরা পরিপূর্ণ বিকশিত হতে পারে না। শিশুদের বিকাশে শিক্ষকদের উন্নত মন-মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। এটি সকল শিক্ষকের নৈতিক ও মহান দায়িত্ব। কারণ শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং শিশুদের মানসিক বিকাশে মাতা-পিতা ও শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।