শাহ আজিজুর রহমান তরুণ

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না কিন্তু অনেকেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চায় না। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্বোধনী শ্লোগান ছিল নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ নৌকার মালিক তুই আল্লাহ। ১৯৫৬ সালের ৭ ও ৮ ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে সম্মেলন করে মুসলিম জাতিসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে সেকুলার আদর্শ গ্রহণ করে ওই দলটি। শুধু তাই নয় ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন সম্প্রসারণের প্রথম ধাপ হিসেবে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির “জয়” এদেশে আমদানি করা হয়। নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবারকে চিরতরে কবরস্থ করে, জিন্দাবাদকে মুছে দিয়ে আমদানি করা ভারতীয় আধিপত্যবাদের “জয়” দিয়ে নতুন শ্লোগান-জয় পাকিস্তান শুরু করেছিল। এভাবেই ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যবাদ আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী হয়েছিল। এর মাত্র এক দশকের ব্যবধানে আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের ডালপালা বিস্তার করে নিজেদের তলপি বাহক কিছু বিপদগামী ছাত্রনেতার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে জয় পাকিস্তানের পরিবর্তে জয় বাংলা শ্লোগান শুরু করে।

ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন সম্প্রসারণ দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে তারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আগরতলায় রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রের মেতে উঠে। ১৯৭০ সালে শ্লোগান ছিল জয় বাংলা। এ দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের চূড়ান্ত লড়াই ছিল এদেশের তথাকথিত কিছু ছাত্রনেতা পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীকে নিজেদের এজেন্ট নিয়োগ করে দেশকে গৃহযুদ্ধ ও অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয়া।

দেশের মানুষ ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের ক্রীড়নক হিসেবে জয় বাংলা শ্লোগানকে স্বায়ত্তশাসনের শ্লোগান হিসেবে গ্রহণ করে, জনগণকে উজ্জীবিত করার শ্লোগানে রূপান্তর করে। জয় বাংলা শ্লোগানকে এদেশের মানুষ গ্রহণ করেছিল অধিকার আদায়ের শ্লোগান হিসেবে। এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ভারত নিজের আধিপত্যবাদী আগ্রাসন বাস্তবায়ন করার সুযোগ পেতে চায়।

২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে হেলমেট লীগ জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর বর্বর অত্যাচার করেছিল। অবশেষে ৩৬ শে জুলাই দুপুরের রান্না করা খাবার রেখে লক্ষণ সেনের মত গণভবন থেকে পালিয়ে গেছে, পালানোর সময় লাগেজ ভর্তি টাকা-পয়সার সাথে “জয় বাংল” শ্লোগানকেও সাথে করে নিয়ে গেছে। আমরা এ জীবনে জয় বাংলা শ্লোগানের কত রূপ দেখেছি। কতভাবে এই শ্লোগানকে উপভোগ করা হয়েছে। ধর্ষণের সেঞ্চুরি থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে লাশের পাহাড় গড়া হয়েছে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে। কলকাতার দাদাদের রাজত্ব পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছিল এ জয় বাংলা শ্লোগান।

ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে যারা বরদাস্ত করতে পারেনি, আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে যারা নিজের বুকের তাজা রক্তে প্রতিহত করার আমরণ চেষ্টা চালিয়েছে তাদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে কলঙ্কিত করা হয়েছে এই জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে।

ইতিহাস বড়ই নির্মম, বালির বাঁধ দিয়ে সত্য ইতিহাসের স্রোত আটকানো যায় না। ঘটনার সময় ঘটনার কুশীলবরা ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে, প্রকৃত সত্য ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখে প্রকাশ হতে দেয় না, তাইতো প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয় অনেক পরে। কখনো অর্ধশত বৎসর কখনো শত বছর পরে কখনোবা আরো অনেক পরে। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে। একাত্তর থেকে ২০২৪। ৩৬শে জুলাই আন্দোলনে এদেশের মানুষ যখন ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারে তখন সচেতন জনগণ সারা দেশে একযোগে রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্র-ছাত্রী কৃষক শ্রমিক আবাল বৃদ্ধবনিতা খালি হাতে রাস্তায় নেমে আসে, বন্দুকের মুখে বুক পেতে দেয়। এ দৃশ্য দেখে আধিপত্যবাদের দোসরেরা এদেশে অবস্থান করা নিরাপদ মনে করে না, তাই দলীয় প্রধান, সরকার প্রধান এমনকি মসজিদের ইমাম সকলে পালাতে শুরু করে। পালাতে পালাতে তারা ঠিক সেখানেই গিয়ে হাজির হয় যেখান থেকে জয় বাংলা শ্লোগানের নির্দেশ এসেছিল।

ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে শ্লোগানকে এদেশের মানুষ গ্রহণ করে নিয়েছিল, যে শ্লোগান ছিল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার ধ্বনি, বিজয়ের শ্লোগান, সেই শ্লোগান যে ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের অন্যতম প্রতীক ছিল দেশের মানুষ সেটা অনেক পরে বুঝতে পারে। জয় বাংলা শ্লোগান যখন আওয়ামী পেশীশক্তি প্রদর্শনের শ্লোগান হয়ে যায়, গুম খুন আয়না ঘর প্রতিষ্ঠার শ্লোগান হয়ে যায়, দিনের ভোট রাতে নেওয়ার শ্লোগান হয়ে যায়, বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার শ্লোগান হয়ে যায়, দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টির শ্লোগান হয়ে যায়, তখন দেশের মানুষ বুঝতে পারে এসবের মূল হচ্ছে আগে ভারতীয় আধিপত্যবাদ। তাইতো দেশের জনসাধারণ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সীনা উঁচু করে দাঁড়ায়। ভারতীয় আধিপত্যবাদ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়, ভূলুণ্ঠিত হয় জয় বাংলা শ্লোগান। এখন রাতের অন্ধকারেও কেউ জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ার সাহস পায় না।

জয় বাংলা শ্লোগান হয়ে যায় ধ্বংসের প্রতীক। এখন এদেশে একে অন্যকে গালি দিতে বলে জয় বাংলার চামচা, ভয় দেখাতে বলে জয় বাংলা কইরা দিমু। নীতিভ্রষ্ট নেতা নেত্রীর মন্দ কিছু হলে বলে জয় বাংলা হয়ে গেছে।