সাদিয়া সুলতানা রিমি

বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে চলা তাপপ্রবাহ দেশের কৃষি ও পোলট্রি খাতের জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে। উচ্চ তাপমাত্রা, অস্বাভাবিক গরম এবং খরা, কৃষক ও পোলট্রি খামারিদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিখাতে উৎপাদন হ্রাস, ফসলের ক্ষতি, এবং পোলট্রিখাতে প্রাণী মৃত্যু হচ্ছে দ্রুতগতিতে, যা কৃষকদের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে সংকটে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ যাতে এই সংকট মোকাবিলা করা যায়।

বাংলাদেশে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে, যা অস্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি অংশ, যেখানে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটছে। তাপপ্রবাহের কারণে কৃষি ও পোলট্রি খাতের যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিম্নলিখিতভাবে বিশ্লেষিত হতে পারে:

বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ, যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। দেশের অধিকাংশ ফসলই গ্রীষ্মকালে চাষ হয় এবং তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সেগুলির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষত বোরো ধান, শীতকালীন ফসল এবং বিভিন্ন প্রকারের ফলমূলের উৎপাদন কমে গেছে। বোরো ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য এবং দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল। তাপপ্রবাহের কারণে ধানের ফুল ফোটার সময় পলিনেশন (পরাগায়ন) ব্যাহত হচ্ছে, ফলে ধানের শীষে দানা কম আসছে। তাপমাত্রা বেশি হলে ধানের বৃদ্ধি রুদ্ধ হয়ে যায় এবং শস্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। এছাড়া, ফসলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থার অভাবও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপপ্রবাহের কারণে ফলমূল যেমন আম, লিচু, পেয়ারা, আনারস এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষত দিনাজপুর ও রাজশাহীর মতো অঞ্চলে আম ও লিচুর বাগানগুলো তীব্র তাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার কারণে ফলের গুণগত মান ও পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, ফলে কৃষকদের ক্ষতি হচ্ছে। তাপপ্রবাহের কারণে কৃষকরা নিজেদের জমিতে অত্যধিক খরচে সেচ দিতে হচ্ছে। ফলে কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, অসংলগ্ন বৃষ্টিপাতও ফসলের ক্ষতির কারণ হিসেবে কাজ করছে। কিছু কিছু অঞ্চলে খরা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পোলট্রি খাত বাংলাদেশের একটি বড় অর্থনৈতিক খাত, যেখানে লক্ষাধিক মানুষ জড়িত। তাপপ্রবাহের কারণে পোলট্রি খাতে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। মুরগি ও অন্যান্য পাখিদের তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে চলতে পারা অত্যন্ত কঠিন, এবং উচ্চ তাপমাত্রায় পোলট্রি খামারে মুরগির মৃত্যু অনেক বেশি হচ্ছে। এর পাশাপাশি, মুরগির খাদ্য গ্রহণও কমে যাচ্ছে, ফলে ডিম উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং পোলট্রি ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিদিন পোলট্রিখাতে মুরগি মারা যাচ্ছে, যা একটি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। তাপপ্রবাহের কারণে মুরগির শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং এর ফলে অকাল মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পোলট্রি খামারের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা। কারণ খামারিরা যদি খামারের জন্য উপযুক্ত শর্ত তৈরি করতে না পারেন, তবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

তাপমাত্রার কারণে পোলট্রি খামারে মুরগির খাদ্য গ্রহণ কমে যাওয়ায় গোশতের উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। পোলট্রি খামারের খরচ বাড়ছে, এবং মুনাফা কমছে। এছাড়া, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পোলট্রি খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা আরও বেড়েছে। তাপপ্রবাহের কারণে কৃষিখাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

তাপ সহনশীল ফসলের চাষ: তাপ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও চাষ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইজজও) তাপ সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে সক্ষম। কৃষকদের এসব জাত চাষে উৎসাহিত করতে হবে।

সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন: সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাপপ্রবাহের সময় জমিতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত না হয়। এছাড়া, সেচ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে পানি সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যবহার করা যায়।

কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষকদের তাপপ্রবাহ মোকাবিলার উপযুক্ত পদ্ধতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন করা দরকার। প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে তাদের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় শেখানো যেতে পারে।

সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি: কৃষকদের তাপপ্রবাহে সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারি ভর্তুকি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সেচ ব্যবস্থার জন্য ভর্তুকি, ফসলের ক্ষতি মোকাবিলা করতে সহায়তা এবং কৃষি বিমা পলিসি উন্নয়ন কৃষকদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

পোলট্রি খাতে তাপপ্রবাহের সংকট মোকাবিলায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

খামারে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: পোলট্রি খামারে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি। পাখির জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা শেড, ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা, এবং পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা: পোলট্রি খামারে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। এ ক্ষেত্রে খামারিদের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

পোলট্রি খামারিদের জন্য ঋণ সুবিধা: পোলট্রি খামারিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তারা ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় এবং তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।

তাপপ্রবাহ বাংলাদেশের কৃষি ও পোলট্রি খাতের জন্য একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। তবে সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তি, এবং সরকারি সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। কৃষক ও খামারিদের জন্য সঠিক তথ্য ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, তাপ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, এবং খামারে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ সংকট মোকাবিলা করতে সবাইকে একযোগভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।