সবাই যখন ধারণা করছিল গাজায় হয়তো বা একটি যুদ্ধ বিরতি হতে পারে। কাতারে গাজা যুদ্ধ বিরতি আলোচনায় মোটামুটি একটি চুক্তির লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিল মধ্যস্থতাকারী কাতারসহ বিভিন্ন দেশ, ঠিক তখনই ভয়ংকর সব খবর চারদিক থেকে আসতে লাগল। না চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি বরং গাজা থেকে প্রতিদিনই মৃত্যু আর ধ্বংসের খবর আসছে। সর্ব সাম্প্রতিক ঘটনায় গাজায় আল জাজিরা টিভির ৫ সাংবাদিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এ ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৫ সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, যুদ্ধের সময় সাংবাদিকদের কখনো লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। জেরুসালেম থেকে এএফপি জানায়, সিপিজের প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ বলেন, ‘সাংবাদিকরা বেসামরিক লোক। তাদের কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। এমন কাজ করা যুদ্ধাপরাধ।’ চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী। ইসরাইল এমন এক অপশক্তি যাকে নিন্দামন্দ করে কোন লাভ নেই। সে তা শোনে না। তবু নিন্দা প্রতিবাদ তো করতে হবে। বেলফাস্টে, তিউনিসিয়ায় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে আরো শহরে।
সাংবাদিক হত্যার বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, ১১ অগাস্ট গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে ইসরাইলের বিমান হামলায় আল জাজিরার পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এরা হলেন- সংবাদদাতা আনাস আল-শরিফ ও মোহাম্মেদ কুরেইকেহ, ক্যামেরাম্যান ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মেদ নৌফাল এবং মোয়ামেন আলিয়া। হামলার সময় তারা হাসপাতালের মূল গেইটের কাছে সাংবাদিকদের জন্য তৈরি করা একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন বলে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে “পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটি ছিলো প্রেস ফ্রিডমের ওপর আরেকটি স্পষ্ট ও পূর্বপরিকল্পিত হামলা”।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাংবাদিক হত্যার একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। এখান থেকে বুঝা যাবে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ এবং ৯/১১-পরবর্তী আফগানিস্তান যুদ্ধ মোট নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যার চেয়েও বেশি। মনিটরিং ওয়েবসাইট শিরিন.পিএস-এর হিসাবে, ২২ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ২৭০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছে, মাসে গড়ে প্রায় ১৩ জন। ওয়েবসাইটটির নামকরণ করা হয়েছে আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর নামে, যাকে ২০২২ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল। (সূত্র: আল জাজিরা)
আরো যা জানা যাচ্ছে, শুধু সাংবাদিক হত্যা করে ক্ষান্ত নয় ইসরাইল। গাজা সিটি নিজ কব্জায় নেয়ার এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছেন যুদ্ধবাজ ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ও গাজার কসাই নেতানিয়াহু। ২৩ লাখ অধিবাসীর গাজার প্রায় এক লাখ মানুষ ইতিমধ্যেই ইসরাইলী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নারী শিশু বেশি। গাজার স্বস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজার। তবে বেসরকারী হিসেবে নিহতের সংখ্যা লাখেরও বেশি। ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলী বাহিনীর এই ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ চলেছেই।
এদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনি উপত্যকার উত্তরে অবস্থিত গাজা শহর দখলের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা। এক সিনিয়র ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানিয়েছে, আগামী ৭ অক্টোবরের মধ্যে গাজা শহর থেকে সব ফিলিস্তিনিকে কেন্দ্রীয় শিবির ও অন্যান্য এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর শহরে থাকা হামাস যোদ্ধাদের অবরুদ্ধ করে স্থল অভিযান চালানো হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নেতানিয়াহুর পরিকল্পনাকে কার্যত সবুজ সংকেত দিয়েছেন। কোন কোন খবরে বলা হয়েছে তাদের এই অভিযান শুরুও হয়েছে।
এ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নকে ভয়ংকর খেলা ছাড়া কি বলা যায়? বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ইসরাইল এই খেলার মধ্য দিয়ে একটি জাতি গোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চায় এটা স্পষ্ট। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলী অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতি নির্মূলের এই তাণ্ডব চলে আসছে। কিন্তু ফিলিস্তনিদের নিবৃত করা ও জাতিগত নির্মূল করা গেছে কি?
নেতানিয়াহুর এ পরিকল্পনাকে বিশ্লেষকরাও ভয়ংকর বলে বর্ণনা করেছেন। তারা বলতে চাইছেন এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলী নেতা নিজ স্বার্থ হাসিল করতে চান। আর গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনায় দেশে-বিদেশে নেতানিয়াহুর পক্ষে কেউই নেই একথা স্পষ্ট। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান যুদ্ধের দু’বছর হতে আর দু’মাসের কম সময় বাকি। আর এমন সময় গাজায় সামরিক অভিযান আরও বিস্তৃত করতে ইসরাইলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভায় একটি প্রস্তাব শুধু ভয়ংকরই নয় কুৎসিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে । বিশ্লেষকরা বলেন, পরিকল্পনাটি যতটা না সামরিক কৌশল, তার চেয়ে বেশি নেতানিয়াহুর নিজের রাজনৈতিক অবস্থান জোরদারের প্রচেষ্টা। বলা হয়েছে, প্রস্তাবটি নিয়ে ইসরাইলের সামরিক নেতৃত্ব ব্যাপক আপত্তি জানিয়েছিল। সামরিক নেতৃত্ব বলেছিল, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে গাজায় মানবিক সংকট আরও বাড়বে এবং সেখানে থাকা ৫০ জিম্মির জীবন বিপন্ন হবে। অনেক জরিপে দেখা গেছে, ইসরাইলের বেশির ভাগ মানুষ চায় যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা হোক। সামরিক অভিযান বিস্তৃত করার পরিকল্পনাটি এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন কিনা বিশ্বে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন কমে গেছে। এমনকি গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইসরাইলি জনগণের সমর্থনও কমে গেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে তবু কেন নেতানিয়াহু তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তার অন্ততপক্ষে একটি হলেও রাজনৈতিক ফায়দা হবে। সেটি হলো, এর মাধ্যমে দিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করার সময় পাবেন। তার কট্টর ডানপন্থী জোটের সঙ্গীরাও চান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক। নেতানিয়াহু এমন একটি পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিচ্ছেন, যা কারোরই মনই জোগাতে পারছে না। যা জানা যাচ্ছে, ইসরাইলের নেতা এখন ধাপে ধাপে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছেন। প্রথম ধাপের লক্ষ্য হলো, শুধু গাজা সিটির দখল নেওয়া। কাছাকাছি থাকা অন্যান্য শিবিরের দখল এখনই নেওয়া হবে না। ধারণা করা হয়, ওই শিবিরগুলোতে ২০ ইসরাইলিকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। নেতানিয়াহু খুব সচেতনভাবে অভিযান শুরুর জন্য দু’মাসের ঢিলেঢালা একটি সময়সীমা দিয়েছেন। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। পুরো পরিকল্পনা বাতিল করারও সুযোগ আছে।
নেতানিয়াহুর সর্বশেষ পরিকল্পনাটি তার জোটসঙ্গী বা ইসরাইলের সামরিক নেতৃত্ব কারোরই পছন্দ হয়নি। দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা ধরে ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বৈঠকটি হয়েছিল। ইসরাইলের সামরিক প্রধান ইয়াল জামির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের পরিকল্পনার কঠোর বিরোধিতা করেন। ইসরাইলের শীর্ষ এ জেনারেল সতর্ক করেন, নতুন কোনো সামরিক অভিযান চালানো হলো, তা গাজায় থেকে যাওয়া ইসরাইলি জিম্মিদের জন্য বিপজ্জনক হবে। এ পরিকল্পনা ইসরাইলি সেনাদেরও ঝুঁকিতে ফেলবে বলে সতর্ক করেন তিনি। ইয়াল জামির আরও বলেন, গাজা এমন একটি ফাঁদে পরিণত হবে, যা প্রায় দুই বছর অবিরাম লড়াইয়ে ক্লান্ত ইসরাইলি বাহিনীর শক্তি আরও কমিয়ে দেবে এবং ফিলিস্তিনের মানবিক সংকটকে আরও গভীর করে তুলবে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী যে উদ্বেগগুলো প্রকাশ করেছে, সেগুলো ইসরাইলের সাধারণ মানুষেরও কথা। অনেক জরিপে দেখা গেছে, ইসরাইলের বেশির ভাগ মানুষ চায়, যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা হোক।
গাজা দখলের পরিকল্পনা নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক মহলে এক অবিশ্বাস্য একাকিত্বের মধ্যে নিয়ে গেছে। পরিকল্পনাটি ঘোষণার পর জার্মানি বলেছে, তারা ইসরাইলের জন্য কিছু সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি স্থগিত করছে। এর মধ্য দিয়ে অন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্যও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও কমিয়ে আনার পথ তৈরি হয়েছে। জার্মানি হলো যুক্তরাষ্ট্রের পর ইসরাইলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করে হামাস। তাদের হাতে জিম্মি হয় প্রায় ২৫০ জন। তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে একান্ত মরিয়া হয়ে তা করেছিল। পরদিন ৮ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজায় যে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তা এখনো থামেনি। মাঝে দু’দফায় অল্প দিনের যুদ্ধবিরতি বাদে পুরো সময়টা ইসরাইলি হামলা অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক মহলের যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করেই তারা এ হামলা অব্যাহত রেখেছে। গত প্রায় ২১ মাসে ইসরাইলি আগ্রাসনে ৬১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক শক্তি বা বিশ্ব মোড়লরা কোথায়? তারা গাজা প্রশ্নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিছু উদ্যোগ নিলেও ইসরাইল মানেনি। আর ইসরাইলের সহযোগী আমেরিকা তাতে দিয়ে গেছে ভেটোসহ নানান বাগড়া। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলী প্রশাসনকে আগের বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা ও সাহায্য দিচ্ছে। শুধু তাই নয় তাদের আহবানে ইরানে বোমা হামলা পর্যন্ত করেছে আমেরিকান বাহিনী। ফলে তাদের কাছ থেকে এ রকমই আচরণ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গালান্তের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়া গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) মামলা চলমান রয়েছে।
আর মাঝে একটা ঠুনকো যুদ্ধ বিরতি হলেও ইসরাইল তা ভেঙ্গে দেয়। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবারও গাজায় নির্বিচার হামলা চালায় ইসরাইল। এর পর আর যুদ্ধ বিরতি আলোচনায় কোন ফয়সালা আসেনি, সমঝোতায় আসতে পারেনি হামাস ও ইসরাইল।
ইসরাইলি বাহিনীর গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা কতটা কাজ দেবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এতে গাজায় রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা আরো বাড়বে। বাড়বে নিপীড়িত মানুষের হাহাকার এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।