॥ গত মঙ্গলবারের পর ॥

মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজের একজন সভ্যহিসাবে আমাদেরকে সবার সাথে মিলেমিশে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হয়। বিচ্ছিন্নতা মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। এসময় ধনী-গরীব নির্বিশেষে পরিচিত সবার সাথে মন খুলে কথা বলা উচিত। টেবিলে খাবার এলে অন্যকে আগে দিয়ে পরে নিজে নেয়া উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। খাবার ভালমন্দ যাহোক এ নিয়ে কোন নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না। এতে আমন্ত্রণকারী ব্যক্তি শুনলে কষ্ট পাবে। আপনার ব্যাপারে তার বাজে বা কুধারণার জন্ম নেবে। ফলে ভবিষ্যতে এমন অনুষ্ঠানে আপনাকে আর দাওয়াত নাও দিতে পারে। কোন দরকারী পরমর্শ ও বৈঠকেও ডাকার সম্ভাবনা কম। এতে পারিবারিকভাবে আপনার গুরুত্ব কমবে। আর এ অবমূল্যায়নের জন্য আপনি নিজেই দায়ী হবেন। যা আপনার ভোগান্তির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তথা পরচর্চা না করে নিজেকে নিয়ে ভাবাটা বেশি জরুরি। আপনি যেমন চান না অন্য কেউ আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করুক, ঠিক অন্যরাও চায় না আপনি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুন। এছাড়া সৃজনশীলভাবে কথা বলাটা জরুরি। বাঁকা ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথা পরিহার করা উচিত। অন্যের ভাল কাজে উৎসাহ দেওয়া সমাজের সভ্য হিসাবে আপনার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। খারাপ কিছু চোখে পড়লে তিরস্কার না করে বুঝিয়ে বলাই বাঞ্ছনীয়। পারলে পরামর্শ দিতে হবে যাতে সে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হয়। কাউকে অযথা সমালোচনা বা অসম্মান করা যাবে না। আর এতে সামাজিক তিক্ততা সৃষ্টি হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অস্থিরতাও দেখা দেয়।

অনেক সময় আমরা নিজের সামর্থ্য থাকার পরও বারবার অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। অথচ নিজে কখনো তাকে কিছু দিই না। রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে অন্যের পকেটের অবস্থা না বুঝে দামী খাবারের অর্ডার দেয়া একশ্রেণির মানুষে মস্তবড় বদ অভ্যাস রয়েছে। এটাকে অমার্জনীয় অপরাধও বলা যায়। অথচ বিল পরিশোধের সময় অন্যের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেই। এ ধরনের স্বভাব থাকলে যত দ্রুত সম্ভব তা পরিহার করা উচিত। এ ধরনের মানুষদের সবাই পাশ কাটিয়ে চলে। ঘৃণাও করতে পারে। কেউ বিশ^াস করে না; বিশ্বাস করে না, স্বার্থপর ও লোভী ভাবে। যা লোক সমাজে আপনাকে হেয়প্রতিপন্ন করবে।

অনেক সময় আমরা বিপদে পড়লে অনেক মিথ্যা কথা বলে টাকা পয়সা ধার করি। অথচ পরিশোধের সময় কোন খেয়াল থাকে না। দিনের পর দিন পার হলেও ঋণের টাকা ফেরৎ দেই না। প্রয়োজনে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেই। বারবার মিথ্যা আশ্বাস দেই। অথচ নিজের সমস্যার কথা মন খুলে তার সাথে শেয়ার করলে, কেন তার ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তা জানালে লোকটি খুশিই হবে। আপনার প্রতি আস্থা রাখতে পারে। হয়তো লোকটি আপনার সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য কোন পরামর্শও দিতে পারে। তাই পাওনাদারের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো কোনভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ নয় বরং আপনার সমস্যাগুলো তার সাথে যথাযথভাবে শেয়ার করতে পারলে তা হবে আপনার জন্যই কল্যাণকর। আর তার সাথে সম্পর্কটাও থাকে অটুট।

মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশে পোশাক-পরিচ্ছদও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে ড্রেসআপ করাটা খুবই জরুরি। এছাড়া পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি পোশাক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় পোশাক-আশাক মানানসই হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় জুতাটি পরিচ্ছন্ন ও মানানসই নয়। চশমার বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কারণ, আল্লাহ আপনাকে উত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। তাই আপনার উদাসীনতার কারণে যেন আপনার ব্যক্তিত্বের সম্মানহানি না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

আমাদের সমাজে অধঃস্তন কর্মচারীদের সাথে আমরা অনেকে বাজে আচরণ করি। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের অধঃস্তন কর্মচারদের সাথে কোন ভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। তাদের যেকোন ভুলত্রুটি বা সমস্যা সম্পর্কে ভদ্রভাবে নিচু গলায় বুঝিয়ে কথা বলতে হবে। মনে রাখবেন আপনি তার চেয়ে বেশি জানেন ও বোঝেন বলেই আপনি তার ঊর্দ্ধতন। তাই অধঃস্তন কর্মচারির ভুলগুলো শুধরে দেওয়াই আপনার কর্তব্য ও দায়িত্ব। এতে আপনার সম্মানই বৃদ্ধি পায়।

নিজেকে বুঝতে ও পৃথিবীটা জানতে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের কোন বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রচুর পারিপার্শিক ও সমসাময়িক জ্ঞানার্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার কোন বয়স নেই। বস্তুত, মানুষের জীবনটাই একটা বৃহৎ পাঠশালা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা নিতে হয়, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। আপনি পারিবারিক, সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয় যে কোন পর্যায়ে, যে কোন বিষয়ে কথা বলুন না কেন বিষয়টি ভালভাবে জানাটা খুব জরুরি। আর জ্ঞান অর্জন না করলে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির জানা, বোঝা ও বোঝানোর ক্ষমতার ওপর।

মানবিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও বিবেকের পরিস্ফুটনের মাধ্যমে। নীতিবাক্য মুখস্ত করে, বিখ্যাত দার্শনিকদের জীবন দর্শন চোখ কান বন্ধ করে পড়লে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এজন্য প্রয়োজন জানার ও শেখার পাশাপাশি নিয়মিত চর্চা করা। আর এগুলো বুঝে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। হঠাৎ করে এ গুণাবলী অর্জন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য অল্প বয়স থেকেই শুরু করা আবশ্যক। মূলত, জ্ঞানই শক্তি। আর জ্ঞানই পারে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মনুষত্ব বিকাশে সহায়ক হতে। তাই মনীষীরা বলেছেন, জ্ঞানার্জন ধনার্জন অপেক্ষা মহত্বও’। আর জ্ঞানই পারে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে আলোকিত ও বিকশিত করতে। (সমাপ্ত)

[email protected]