১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে প্রহসনের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মর্মান্তিক পরিণতির পর বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়। পুতুল নবাব হিসেবে বাংলার সিংহাসনে বিশ্বাস ঘাতক মীর জাফর আলী খানের অভিষেক ঘটে। শুরু হয় ইংরেজ ও এদেশীয় এজেন্টদের অপশাসন-দুঃশাসন।
মূলত, সিরাজ পরবর্তী বাংলা লুটেরাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় ইংজেরদের লুন্ঠনের বিভৎস চিত্র ভেসে ওঠে। জানা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৩ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয় ৬০ কোটি টাকা। যা বর্তমান বাজারে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ।
এ ছাড়া বেহিসেবী হীরা, জহরত, স্বর্ণ, স্বর্ণের বার ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দোসররা বাংলা থেকে লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। শুধুমাত্র নবাব সিরাজের হীরাঝিল প্রাসাদ থেকেই ১ কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্যমুদ্রা, ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, দু’সিন্দুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স হীরা জহরত, ২ বাক্স চুনীপান্না সহ অসংখ্য মহামূল্যবান জিনিসপত্র লুন্ঠন করা হয়। যার পরিণাম ছিল বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমান।
মূলত, বাংলার লুন্ঠিত অর্থেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। এক সময় তা পরিপূর্ণতাও পায়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ উইলিয়াম ডিগবী (Sir William Digby) বলেছিলেন, England’s industrial supremacy owes its origin to the vast hoards of Bengal and the Karnatik being made available for her use....Before Plassey was fought and won, and before the stream of treasure began to flow to England, the industries of our country were at a very low ebb. (‘Prosperous India: A Revelation, p. 30.)
মূলত, পলাশীপূর্ব বাংলার নবাবগণ ছিলেন সম্পূর্ণ রূপে বাংলা-বিহার-উরিষ্যার নওয়াব নিজাম। মুঘল আমলে যারা সুবাহ বাংলার প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। ১৭১৭ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত তারা সার্বভৌম বাংলার প্রধান হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করেছেন। পদটি মুঘল আমলে পুরষানুক্রমিকভাবে নাজিম ও সুবেদার থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরবর্তিতে তারা সংশিষ্ট অঞ্চলসমূহে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিলেন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার এবং কথিত যুদ্ধে বৃটিশদের কাছে পরাজিত হন। বিশ্বাসঘাতকতার পুরুস্কার স্বরূপ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু তিনি ছিলেন মূলত পুতুল নবাব। ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি ছিল ইংরেজদের হাতেই।
সিরাজ পরবর্তী বাংলায় ১৭৬৫ সালে দ্বৈত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কথিত নবাবগণ ব্রিটিশদের অধীনে শাসন করতেন এবং তারা ব্রিটিশদের হাতের পুতুল ছিলেন। ১৭৭২ সালে ধারাটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে শাসন ব্যবস্থা সরাসরি ব্রিটিশদের অধীনে নেওয়া হয়। ১৭৯৩ সালে নবাবদের কাছ থেকে নিজামত (গভর্নর) অধিকারও প্রত্যাহার করে নেয় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। তখন তাদেরকে ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র অবসরকালীন ভাতা দেওয়া হত। শাসনকাজে তাদের কোন অংশ গ্রহণ বা ক্ষমতা ছিল না। বাংলার শেষ নবাব মনসুর আলী খান ১৮৮০ সালের ১লা নভেম্বর তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। আর এখানেই বাংলার নবাব পদটির অপমৃত্যু ঘটে।
মূলত, মনসুর আলী খানের পদত্যাগের পর মুর্শিদাবাদের নবাব ও বাংলার নবাব পদটি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর হিসেবে পরিচিতি পায়। যেহেতু ১৮৮০ সালে বাংলার নবাব উপাধিটি বিলুপ্ত হয়েছিল। সে সময় রাজস্ব আদায়ে তাদের খুবই কম বা অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ছিল না বললেই চলে এবং তারা বল প্রয়োগ থেকেও বিরত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর রাজ্যসমূহের ভারত বা পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হওয়ার বাধ্যবাধাকতা ছিল। উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদ দু’দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়েছিল।
কারণ, এখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট এটি ভারতের অঙ্গীভূত হয়। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ভারতের সাথে একত্রিত হওয়ার পর এসব রাজ্যসমূহের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়। কারণ, ভারত সরকার সকল রাজ্যসমূহের কর্তৃত্ব এক কেন্দ্রে কেন্দ্রিভূত করেছিল। ১৯৬৯ সালে শেষ নবাব ওয়ারিস আলী মির্জার মৃত্যুর সাথে সাথে নবাব উপাধিটিও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গিয়েছিলেন কিন্তু তার মৃত্যুর পূর্বে কোন উত্তরাধীকারী ঘোষণা না করে যাওয়ায় নবাব উপাধিটিও এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
শহীদ নবাব সিরাজদ্দৌলার পরবর্তী সময়ে মীর জাফর সহ তার বংশধররা নবাবী পদ অলঙ্কৃত করলেও তারা ছিলেন নামমাত্র নবাব। ইংরেজরা তাদের হাতে কোন ক্ষমতা দেয়নি বরং পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতার নজরানা স্বরূপ তাদের ভাগ্যে জুটেছিল প্রভূত আর্থিক সুবিধা। বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেশের শাসনভার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দিয়ে সে অর্থে তারা শুধু ভোগবিলাসই করে গেছেন। বাংলা প্রায় ২’শ বছরের জন্য স্বাধীনতা হারিয়েছিল। বাংলার মানুষের ভাগ্যে নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। জাতির গলায় পরাধীনতার জিঞ্জির তুলে দিয়ে মীর জাফর ও তার বংশের কথিত নবাবরা ইনাম হিসেবে যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে তারা ইন্দ্রিয়বিলাসই করে গেছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনকে উপভোগ করেছেন। সাধারণ মানুষকে নিয়ে তাদের পক্ষে ভাববার কোন সুযোগই ছিল না।
নবাব আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমের গর্ভজাত এবং মীর জাফরের ঔরসজাত সন্তান মীর সাদেক আলী খান মিরনের বজ্রপাতে মৃত্যু হলে সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের কথিত নবাবী। মিরনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে ইংরেজরা তাকে হরিণ শিকারের কথা বলে গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে তাবুতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন বলে প্রচার চালায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় এই দাবির পক্ষে প্রমাণও মেলে।
কারণ, মিরনের মৃত্যু হয়েছিল অগ্নিদগ্ধ হয়ে। দগ্ধ হওয়ার কারণে মৃতদেহ চেনার কোন উপায় ছিল না। মীর জাফর তখনও জীবিত ছিলেন। মিরনের লাশ এতই বিভৎস হয়েছিল যে, মীর জাফরকে সন্তানের লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। তিনি পুত্রশোকে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন। যা ছিল মাত্র তিন বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। কারণ, তিন বছর আগেই নবাব সিরাজ জননী আমিনা বেগম একইভাবে পুত্র শোকে মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন।
১৭৬৫ সালে মীর জাফরের মৃত্যুর পর তার ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈয়ের গর্ভজাত নজমউদ্দৌলা (১৭৬৫-৬৬ খ্রী.)-কে কোম্পানী বাংলার নবাব বানায়। ঐতিহ্যবাহী বাংলায় শুরু হয় বাঈজী বংশের তথাকথিত নবাবী। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বব্বু বাঈও ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। নবাব মাতা হতে তিনিও বাদ পড়েননি। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বব্বু বাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারক উদ্দৌলা (১৭৭১-৯৩)। মুন্নী বাঈয়ের চাইতে বব্বু বাঈ ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। কারণ, পরবর্তীতে তারই পুত্র ও পৌত্রগণ ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন। সে ধারাবাহিকতা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আর এখন পর্যন্ত সে ধারাটিই অব্যাহত আছে।
নবাব সিরাজের শাহাদাতের পর ইংরেজরা বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকেই পুতুল নবাব বানিয়েছিল। কিন্তু তার হাতে কোন ক্ষমতাই ছিল না। ইংরেজরা সিরাজ পরবর্তী নবাবদেরকে শুধুমাত্র বার্ষিক ভাতা প্রদান করতো। এ ভাতা ছিল মীর জাফর ও তার বংশধরদের জন্য বিশ্বাসঘাতকতার ইনাম স্বরূপ। এছাড়া এসব পুতুল নবাবরা বাংলা ও বাংলার মানুষের জন্য কিছুই করেনি। সিরাজ পরবর্তী মীর জাফর ও তার বংশের কথিত নবাবদের তালিকা ও ভোগবিলাসের সময়কাল নিম্নরূপ-
নবাব সিরাজকে ২ জুলাই গভীর রাতে নির্মমভাবে শহীদ করার পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খানকে সিংহাসনে বসায়। প্রথম মেয়াদে মীর জাফরের নবাবীর মেয়াদ ছিল ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত। ১৭৬০ সালে ইংরেজরা মীর জাফরকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে এবং তারই জামাতা মীর কাসিম আলী খানকে সিংহাসনে বসায় (১৯৬০-১৭৬৩)। কিন্তু ইংরেজদের সাথে বনীবনা না হওয়ায় এবং যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় ইংরেজরা ১৭৬৩ সালে আবারও মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসায় (১৭৬৩-১৭৬৫)। আত্মমর্যাদাহীন ও ক্লাইভের গর্দভ খ্যাত মীর জাফর এতে মোটেই আপত্তি করেন নি। ১৭৬৫ সালে মীর জাফরের মৃত্যু হলে মুন্নী বাঈয়ের পুত্র নাজিম উদ্দীন আলী খান ওরফে নজম উদ দৌলা (১৭৬৫-১৭৬৬৬)কে নবাব বানানো হয়। ১৭৬৬ সালে তার মৃত্যু হলে মুন্নী বাঈয়ের আরেক পুত্র নাজাবুত আলী খান ওরফে সাইফ উদ দৌলা (১৭৬৬-১৭৭০) নবাব হন।
এরপর শুরু হয় বব্বু বাঈয়ের বংশধারার নবাবী। নজম উদ দৌলার মৃত্যুর পর বব্বু পুত্র আশরাফ আলী খান ওরফে মোবারক উদ দৌলা (১৭৭০-১৭৯৩) নবাবী পান। এরপর বাবর আলী খান ওরফে আজাদ উদ দৌলা (১৭৯৩-১৮১০), জাইন উদ্দিন আলী খান ওরফে আলী জা (১৮১০-১৮২১), আহমেদ আলী খান ওরফে ওয়াল্লা জা, (১৮২১-১৮২৪), মুবরক আলী খান ওরফে হুমায়ন জা (১৮২৪-১৮৩৮), মনসুর আলী খান ওরফে ফেরাদুন জা, (১৮৩৮-১৮৮১), হাসান আলী খান মীর্জা ওরফে আলী কাদির (১৮৮২-১৯০৬), ওয়াসিফ আলী খান ওরফে আমীর উল উমরা, (১৯০৬-১৯৫৯) এবং ওয়ারিশ আলী মির্জা ওরফে রেইস উদ দৌলা, (১৯৫৯-১৯৬৯)। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, মীর জাফর পরবর্তী ২ জন নবাব তথা নজম উদ দৌলা ও সাইফ উদ দৌলাকে ইংরেজরাই বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল। (চলবে)