মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
কৌতুহল হলো বৈজ্ঞানিক চিন্তার মূল সূত্র। আর আল কুরআন মানুষের মনের মধ্যে জীবন ও জগত সম্পর্কে এমন কৌতূহল বোধই জাগিয়ে তুলতে চায়। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর দয়া ও মহত্ত্ব কে উপলব্ধি করার জন্য কুরআন কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের কথা বলেনি, বলেনি জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করার কথাও বরং আল কুরআনের পরতে পরতে অল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য মানুষের বিবেকবোধকেই নাড়া দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে সৃষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে স্রষ্টার নিদর্শন। স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য বিভিন্ন যুক্তি-প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষের বিবেক ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানোর আহবানের মাধ্যমে আল কুরআনে মূলত মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
লোকেরা যখন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী হয়, আকাশ, পৃথিবী, প্রকৃতিরাজ্যের রহস্য জানতে চায় তখনই তারা বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু, বেশির ভাগ লোকের মধ্যেই এ কৌতূহলবোধের অভাব রয়েছে। তাদের কাছে মহাকাশ ও প্রকৃতির রহস্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, বরং সংকীর্ণ ও স্থূল বৈষয়িক লাভ ও আনন্দই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেসব সমাজে এ ধরনের লোকেরাই নেতৃত্বস্থানীয় হয়, সেসব সমাজে বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয় না। অলসতা ও অজ্ঞতাই তখন তাদেরকে শাসন করে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব সমাজের লোকগুলো ছিল এ ধরনের। আসলে, আল্লাহ যে কত দয়ালু, কত মহান তা তাঁর সৃষ্টি জগতের দিকে তাকালে বোঝা যায়। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি উপাদান আল্লাহর অপার করুণার প্রকাশ। এ বিশাল মহাবিশ্ব, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি মানুষের জীবনও তাঁর অসীম দয়া ও ভালোবাসার নিদর্শন। সুতরাং আল্লাহর দয়া ও মহত্বকে জানতে হলে তাঁর সৃষ্টিকে জানতে হবে।
আল কুরআন মানুষকে তাদের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার এবং মনকে কাজে লাগানোর আহবান জানায়। আল কোরআনে বলা হয়েছে -‘তারা কী তাদের উটগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে না কীভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে? আর আকাশের পানেও লক্ষ্য করে না কীভাবে তাকে উর্ধে তুলে ধরা হয়েছে? পাহাড়গুলোও কী দেখে না কীভাবে তাকে সুদৃঢ় ভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে? আর তারা কি জমীনের প্রতিও লক্ষ্য করে না কীভাবে তাকে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে? অতএব তাদেরকে সচেতন-সতর্ক করতে থাকো। আর তুমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র।’ -[সূরা আল গাসিয়া : আয়াত ১৭-২১]
এভাবে আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ সৃষ্টি জগতের প্রতি, প্রকৃতিরাজ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করার ও সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার, শিক্ষা গ্রহণ করার, গবেষণা করার জন্য লোকদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। কেননা, সৃষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে স্রষ্টার অপরিসীম দয়া, তাঁর সৃষ্টিনৈপুণতা, নিখুঁত পরিকল্পনা, সৃষ্টি জগতের উপর তাঁর অপরিসীম কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ঈমানদারদের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে যেয়ে বলেছেন যে, তারা সব সময় আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।
সূরা আলে ইমরানের ১৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন : ‘তারা হলো সেসব লোক, যারা ওঠা, বসা ও শয়ন - সর্বাবস্থায় আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বলে: হে আমাদের প্রভু, এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল প্রশংসা কেবল তোমারই প্রাপ্য। অতএব, দোযখের আযাব থেকে তুমি আমাদেরকে রক্ষা কর।’
নদী অথবা সাগরের তীরে দাঁড়ালে মনে হয় এর দিগন্ত রেখা আকাশের সাথে মিশে গেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু অথৈ পানি আর পানি। আবার দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সবুজ অরণ্য, মরুভূমির ধুধু বালুচর, রাতের নীলাকাশ অথবা পাহাড়ের সামনে দাঁড়ালেও মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি এই পৃথিবী কত বিশাল। অথচ আমরা সবাই জানি, মহাকাশের তুলনায় এই পৃথিবী কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য।
বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাকাশের তুলনায় এ পৃথিবী একটি ক্ষুদ্র বালুকণার সমান। আমাদের এ সৌরজগতে বৃহস্পতি নামের গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১৩০০ গুণ বড়। এর মানে হল, বৃহস্পতি গ্রহের ভেতরে প্রায় ১৩০০টি পৃথিবী স্থান পেতে পারে। সৌরজগতে পৃথিবীসহ নয়টি গ্রহ ও তাদের উপগ্রহসমূহ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এ সূর্য পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। আবার সূর্য মধষধীু’র তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র। সূর্য একটি মাঝারি সাইজের নক্ষত্র। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এরকম ২০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। এটি একটি বিশাল সংখ্যা। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি সর্পিলাকার ছায়াপথ, যেখানে এই বিপুল সংখ্যক নক্ষত্র মহাকর্ষীয়ভাবে আবদ্ধ হয়ে একটি কাঠামো তৈরি করেছে। নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করে। মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলোর চেয়েও বড় কাঠামো হলো সুপারক্লাস্টার বা ছায়াপথগুচ্ছ। এগুলো হলো গ্যালাক্সিগুলোর বিশাল সংগ্রহ, যা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে একত্রিত থাকে। একটি সুপারক্লাস্টারে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার গ্যালাক্সি থাকতে পারে।
মহাবিশ্বের বিশালতা সম্পর্কে বিজ্ঞান যা বলে : পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ, যা প্রায় ৮.৮ ী ১০^২৬ মিটার। এতে আনুমানিক ২০০ বিলিয়ন থেকে ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকতে পারে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে ১০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত নক্ষত্র থাকতে পারে। মহাবিশ্বের প্রায় ৭৫% ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি (অদৃশ্য বস্তু ও শক্তি) দিয়ে গঠিত, যা এখনও সম্পূর্ণরূপে বোধগম্য নয়। মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের বিশালতা এবং এর রহস্যময়তা মানুষের কৌতূহলকে আকর্ষণ করে। বিজ্ঞানীরা এখনও মহাবিশ্বের গঠন, উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন।
আলোর গতিতেও পুরো মহাবিশ্ব ভ্রমণ করা সম্ভব নয়, যা এর বিশালতা প্রমাণ করে। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের পৃথিবী একটি ধূলিকণার মতো। মহাবিশ্বের এই বিশালতা এবং জটিলতা মানুষের ধারণার বাইরে। মহাবিশ্বের বিশালতা কেবল সংখ্যা দিয়েই বোঝানো সম্ভব নয়, এটি একটি অসীম এবং রহস্যময় জগৎ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরো মহাকাশের খুব সামান্যই মানুষ জানতে পেরেছে। মহাবিশ্ব অসীম। এর বিশালতা কল্পনাতীত এবং এর সঠিক আকার এখনো অজানা। এখন পুরো বিষয়টি নিয়ে একবার চিন্তা করা যেতে পারে - মহাকাশ বা মহাবিশ্ব কত বিশাল, কত বড় এবং সে তুলনায় আমাদের পৃথিবী কত ছোট বা ক্ষুদ্র। মহাবিশ্বের বিস্তৃতি এতটাই বিশাল যে, শুধু এ পৃথিবী কেন, আমাদের সৌরজগত বা গ্যালাক্সিও এর তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ বিশাল মহাকাশের বুকে আমাদের এ ক্ষুদ্র পৃথিবীই পেয়েছে বিশেষ মর্যাদার আসন। আল কুরআনের বহু জায়গায় যেখানেই আকাশ সমূহ বা মহাকাশের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেই পাশাপাশি পৃথিবীরও উল্লেখ রয়েছে “আকাশ সমূহ ও পৃথিবী” অথবা “সাত আসমান ও পৃথিবী এই সমাসবদ্ধ পদের মাধ্যমে। কারণ কি?
কারণ, এটি আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের আবাসস্থল। এখানে মানুষ ছাড়াও গাছপালা, প্রাণী এবং বিভিন্ন ধরনের জীবন্ত জিনিস বাস করে, তবে সেসবও মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। সূরা আল-জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর তিনি তোমাদের জন্য আকাশ সমূহ ও পৃথিবীর সবকিছু অনুগত করে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।” [সূরা আল-জাসিয়া, আয়াত ১৩]
তিনি আরো বলেছেন - “তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে স্থিতিশীল করেছেন এবং আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ এবং তিনি তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতিকে করেছেন সুন্দর এবং তোমাদেরকে রিযিক দান করেছেন পবিত্র বস্তু থেকে। তিনিই আল্লাহ্, তোমাদের রব! সুতরাং সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্ কত বরকতময়!” (সূরা ৪০:৬৪); মহান আল্লাহ অতিশয় সুনিপুণ স্রষ্টা” (২৩:১৪)। সুতরাং আমরা আমাদের মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যিনি আমাদের জন্য এত কিছুর আয়োজন করেছেন। আমাদের প্রতি তাঁর দয়া সীমাহীন।
লেখক : সাংবাদিক