মানুষ তো প্রকৃতিরই অংশ; শ্রেষ্ঠ অংশ। মহান স্রষ্টা সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন মানুষ। সুন্দর মানুষের কাজও সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সবসময় তা হয় কি? বর্তমান সভ্যতা মানুষের অনেক কাজই প্রকৃতিবান্ধব নয়। ফলে প্রকৃতিতে বিপর্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জলবায়ুতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে পরিবর্তন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের হিমবাহ ‘মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন’-এর কারণে গলে যাচ্ছে। যতটা সময় নিয়ে হিমবাহ তৈরি হয়, তার চেয়ে ৮ গুণ দ্রুততায় এটি গলছে। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এলাকাতেও পৌঁছে গেছে বলে নতুন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। হিমবাহ গলে যাওয়ার বিষয়টি মানুষের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। প্রকৃতি ভালো না থাকলে মানুষ ভালো থাকবে কেমন করে?

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেচার পরিচালিত সাময়িকী ‘ক্লাইমেট অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক সায়েন্স’-এ ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেইনের একদল বিজ্ঞানী ও পর্বতারোহীর তত্ত্বাবধানে। বিজ্ঞানী ও পর্বতারোহীরা এভারেস্টের হিমবাহে ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা সেখানে বিশে^র সবচেয়ে উঁচু স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনও প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের গবেষণার পরই এভারেস্টের হিমবাহ উদ্বেগজনক হারে গলে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল। একটি হিমবাহ গঠিত হতে লাগে কয়েক দশক। কিন্তু বরফ আলগা হয়ে পড়ায় সে হিমবাহ প্রতি বছর গলছে দ্রুতহারে। এভারেস্টে হিমবাহ তুষার দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ছাদেও মনুষ্যসৃষ্ট উষ্ণতার প্রভাব পাড়েছে।

গবেষণসাটি ২৬ হাজার ৩০০ ফুটের বেশি উঁচু হিমবাহের ওপর ভিত্তি করে সম্পন্ন হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯০-এর দশক থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ হিমবাহের ওপর মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পাষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে। এর ফলে তুষার ধসের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০০ পর্বতারোহীর এভারেস্টে ওঠার বিষয়টিকে বিপদের মুখে ঠেলৈ দিয়েছে। আরও বড় বিষয় হলো, হিমবাহ ধসে পড়লে এশিয়ায় ১০০ কোটির বেশি মানুষের সুপেয় পানি, খাবার ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীর ওপর তাদের জীবন নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য উঁচু পর্বতের হিমবাহের অবস্থা কেমন হতে পারে বা হচ্ছে, তা উপলব্ধি করা যেতে পারে মাউন্ট এভারেস্টের হিমবাহ গবেষণার এ ফলাফলের মাধ্যমে। মূল বিষয় হলোÑ ভুল জীবনযাপন, ভুল সিদ্ধান্ত, ভ্রান্ত শিল্পনীতি, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির আগ্রাসী চেতনা আমাদের প্রকৃতি ও জলবায়ুর বড় ক্ষতি করেছে। এর ফলাফর এখন স্পষ্ট হচ্ছে। গবেষণার ফলাফল কি সভ্যতার শাসকদের সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ হতে উদ্বুদ্ধ করবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বর্তমান সময়ের শাসকরা গবেষকদের গবেষণা কিংবা তথ্য-উপাত্তকে তেমন গুরুত্ব দেন কি? গুরুত্ব দিলে তো আমাদের জলবায়ুর এমন হাল হতো না। আরও ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, উজানের দেশগুলো নদীতে বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশগুলোকে পানিসংকটে ফেলছে। প্রতিবাদ এবং আলাপ-আলোচনার পর ভাটির দেশের সাথে একটা চুক্তি হয়তো হয়। কিন্তু পানি বণ্টনের সে চুক্তি কতটা মানা হয়? রাজনৈতিক টানাপড়েন দেখা দিলে তা তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পানিচুক্তিতে। সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধেও আমরা তেমন চিত্র লক্ষ্য করেছি।

গত ২৪ মে পাকিস্তানের করাচিতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (পিআইআইএ) একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে পিআইআইএ-এর রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট মুহাম্মদ উসমান তার ‘ওয়াটার অ্যাসেটস অ্যান্ড রিসোর্স’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার যে ধারণা রয়েছে, তাতে উজানের দেশ পানিপ্রবাহ আটকে রাখে, আবার ভাটির দেশকে কোনো প্রকার সতর্ক করা ছাড়াই গহঠাৎ করে বন্যার আকারে পানি ছেড়ে দেয়। পাকিস্তান ও ভারতের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ভাটির দেশ ও ভারত উজানের দেশ। তবে চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে চীন উজানের দেশ আর ভারত ভাটির দেশ। তিনি বলেন, ভারত যদি পাকিস্তানে পানি প্রবাহ বন্ধ করতে চায় তবে তার নিজের অঞ্চলেই বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। এছাড়া পানিবন্ধের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে। তা তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হবে এবং সময় লাগবে বেশ কয়েক বছর। সেমিনারে পিআইআইএ চেয়ারপারসন ড. মাসুমা হাসান জানান, চলতি বছরের ২২ এপ্রিলে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় কোনো প্রমাণ ছাড়াই ইসলামাবাদকে অভিযুক্ত করে দিল্লি। এর জেরে ১৯৬০ সালে দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধুর পানি চুক্তি আগাম জানান না দিয়েই স্থগিত করে দেয় ভারত। এদিকে শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে পাকিস্তানের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি উসমান জাদুন বলেন, সিন্ধুর পানি চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লংঘন করেছে ভারত। এর জেরে ২৪ কোটি মানুষের জীবনধারণ হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, মানবাধিকার আইনসহ আন্তর্জাতিক আইনের এটি ভয়াবহ লঙ্ঘন। আমরা কঠোরভাবে এর নিন্দা জানাচ্ছি। ভারতকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন আইনি বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে মেনে চলে এবং পাকিস্তানের ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষাকারী নদীগুলোর পানি বন্ধ বা প্রবাহ বদলানোর যে কোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকে। পাকিস্তানের এ কূটনীতিক বলেনÑ এটি দুঃখজনক, দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে পানিকে বেছে নিয়েছে ভারত। উসমান জাদুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে দাবি জানান, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার। এছাড়া প্রয়োজন হলে প্রাথমিক পদক্ষেপ নেয়ারও দাবি জানান তিনি। জাতিসংঘে পাকিস্তানের ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি উসমান জাদুন আরও উল্লেখ করেন, ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু মন্তব্য উদ্বেগজনক। যেমন ‘পাকিস্তানীদের না খাইয়ে মারার’ মতো মন্তব্য বিকৃত ও বিপজ্জনক মানসিকতার পরিচায়ক। এছাড়া জাতিসংঘের এ প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে বিশ^জুড়ে একটি ঐকমত্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান, যাতে কোনো দেশ পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বানে সাড়া দেবে বিশে^র যে কোনো সুস্থ রাষ্ট্র। কারণ এ আহ্বান মানবাধিকার সম্মত এবং আন্তর্জাতিক আইনসম্মতও বটে। অবশ্য বিকৃত ও বিপজ্জনক মানুষদের কথা আলাদা।

বর্তমান সময়ে পানিসংকট প্রসঙ্গে উজানের দেশ, ভাটির দেশ-এর কথা বারবার উঠে আসছে। বাংলাদেশের যেমন উজানের দেশ আছে, তেমনি ভারতেরও আছে উজানের দেশ চীন। ভারত বাংলাদেশের উজানে ফারাক্কাসহ আরো বহু বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে সমূহ সংকটে ফেলেছে। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ মানুষের জীবন-জীবিকায়ও সংকট দেখা দিয়েছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে মরুপ্রবণতাও। প্রতিবেশী দেশের এমন আচরণ শুধু অবন্ধু সুলভই নয়, অমানবিক এবং বেআইনীও বটে। বাংলাদেশ ভারতের এমন অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে। ফলে পানি বন্টনের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ভারত পানি দিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনায়ও আগ্রহ নেই ভারতের।

প্রতিবেশীদের সাথে পানি নিয়ে ভারতের যে আচরণ তা মোটেও বন্ধুসুলভ নয়, বরং শত্রুতামূলক ও অন্যায়। উজানেরও উজান আছে। ভারতের উজানে আছে চীন। চীন ভারতের উজানে বাঁধ দিচ্ছে এবং সেই বাঁধের আকার ভারতের বাঁধের চাইতে অনেক বড়। ভারত এখানে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের কথা বলছে, মানবিক বিবেচনার কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারত কি উজানের দেশ হিসেবে ভাটির বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে? ভারত যে এখন বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে চীনা বাঁধের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ জানাবে, তেমন নৈতিক অবস্থানে দেশটি নেই। প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথেই ভালো সম্পর্ক নেই মোদি সরকারের। ফলে প্রশ্ন জাগে, মোদির উগ্র হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি কি তাদের কোনো উপকারে আসছে?