প্রিন্সিপাল সাব্বির উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একজন বিশ্ব নেতা হিসেবে তার বডি ল্যাংগুয়েজ বা বডি পোসচার, তার অসাধারণ কথা বলার স্টাইল, তার বাচনভঙ্গি, তার উপস্থাপন শৈলী, বিশ্বনেতাদের সাথে নেটিভদের মতো তার ইংরেজিতে কথোপকথন ও ভাষণ, একজন দক্ষ কূটনীতির মতো অন্যান্য বিশ্বনেতাদের উপর প্রভাববিস্তার এবং বিশ্ব ফোরামগুলোতে তার আকর্ষণীয় সরব উপস্থিতি ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বাঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য দেশে পরিণত হয়েছে।
গত সাত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন, আজারবাইজানে ডি-৮ সামিট, চীন সফর, সর্বশেষ থাইল্যান্ডে সদ্য অনুষ্ঠিত বিমসটেইক সম্মেলনসহ বিশ্ব ফোরামগুলোতে বাংলাদেশকে তার যেভাবে উপস্থাপনতার মধ্য দিয়ে এটা সবার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে কারোর তুলনা হতে পারে না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেই বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তার বিশ্বব্যাপী আকাশ্চুম্বী জনপ্রিয়তা আজ বাংলাদেশের ইমেজ সংকটটির উত্তরণ ঘটিয়ে দেশটির অপার সম্ভাবনা বিশ্বকে জানান দিচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের লোক না হয়েও তিনি যে বিশ্ব রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তা প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক অস্ত্র ইতিমধ্যে অকার্যকরই হয়ে যাচ্ছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
নরেন্দ্র মোদির সাথে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে তিনি যে ভাবে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন
বিশেষ করে ভারতে আশ্রয়ে থাকা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্যে তার ভারতীয় প্রতিপক্ষের নিকট জোরালো দাবি তোলার ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের স্বার্থকে সবার কাছে তুলে ধরে তার দেশকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করাই তার মূল লক্ষ্য। এটি ইতিমধ্যে সবার নিকট প্রতিভাত হয়েছে। ইতোমধ্যে তার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাবক ভূমিকার ফলে মিয়ানমার প্রায় দু’লাখ রোহিঙ্গা নেয়ার কথা জানিয়েছে।
আগামী মাসে বিশ্বের পঞ্চাশটি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাবসায়ীদের নিয়ে তার বৈঠকটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সাহেবের অনুরোধে অনুষ্ঠানে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক যোগ দিবেন। ইতিমধ্যে তার ইন্টারনেট কোম্পানি টেসলার বাংলাদেশে অবাধ ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারে আর কোনো বাধার সম্মুখীন হবে না।
ডি-৮ সামিটে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের সাথে তার কয়েকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকগুলোয় এরদোগান বাংলাদেশে সামরিক ও বাণিজ্য সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকারের কথা জানা যায়। ইতোমধ্যে তুরস্ক আমাদের দেশকে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রোন প্রদান করেছে যা পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে বলে সে দেশের মিডিয়াতে হইচই পড়ে গেছে। তাছাড়া তুরস্ক আধুনিক মিসাইলসহ সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি দিবে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে তার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরফলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠবে যা এতদাঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সাথে অমিমাংসিত ইস্যুগুলো যেমন তিস্তা ও গঙ্গার পানি বন্টন, সীমান্তে বিসএফের বাংলাদেশীদের অহেতুকভাবে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মুখ্য ইস্যুগুলো তুলে ধরে এর ত্বড়িৎ সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করেন। হাসিনার দেশে ফেরানোর বিষয়ে তিনি কথা বলেন। তিনি প্রতিবেশী দেশের সাথে নায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেয়ার কথা বলেন।
সম্প্রতি তার স্বরণীয় উক্তি সেভেন সিস্টার ল্যান্ডল্কড (Landlocked) এবং সঙ্গতকারণে ওশেনের বা সমুদ্রের অভিভাবকত্বের কথা বলেন। এতে প্রতিবেশী দেশের সর্বমহলে ঝড় বইয়ে যাচ্ছে। এতে বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্ঘনে বাংলাদেশ একটি কৌশলগতভাবে অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে বৃহত্তম দেশগুলোর নিকট আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে আমেরিকা, চীন, ভারত সবাই এ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইউনুস অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের উপর শুল্ক আরোপ করায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। সম্প্রতি এক জরুরি বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ করার ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠকে জানানো হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ব্যাপারে সরাসরি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে আলাপ করবেন বলে তার প্রেস সচিব মিডিয়াকে অবহিত করেন।
এতোক্ষণ আমি শুধু পজিটিভ সাইড নিয়ে আলোকপাত করেছি। এখন যে বিষয়টি সবার চোখ এড়াচ্ছে না তা হচ্ছে যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বাঙ্গনে বাংলাদেশকে যেভাবে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে রিপ্রেজেন্ট করছেন তা কিন্তু তার প্রেস উইং সেভাবে তুলে ধরতে পারছে না। তাছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বিদেশ সফর করে আসলে সাধারণত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বা মন্ত্রী পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদেরকে সফর সম্পর্কে ব্রিফ করে থাকেন। কিন্তু অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিটি বিদেশ সফরের শেষে ব্রিফ করছেন তার প্রেস সচিব বা তার প্রেস উইংয়ের একজন সিনিয়র উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে সদ্যসমাপ্ত বিমসটেইক সামিটে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেভাবে তাদের পক্ষে ফলাও করে প্রচার করেছে তা কিন্তু আমাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেনি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সচিবকে নিষ্প্রভ মনে হয়েছে যা কারোর চোখ এড়ায়নি। আমি আবারও বলছি যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব নন্দিত ব্যক্তিত্ব যা আমাদের দেশের জন্যে একটি আশীর্বাদ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কিন্তু তার প্রেস উইংকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। এ ক্ষেত্রে যোগ্য, সৎ ও দেশপ্রেমিক লোকদেরকে নিয়োগ দেয়া খুবই জুরুরি।
আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও ঢেলে সাজানো দরকার। বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সরিষার ভূত আছে কিনা তা উদ্ঘাটন করে সহসা পদক্ষেপ নেয়াটা ও জুরুরি আমরা মনে করি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মহোদয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে অর্জন হবে তা সত্যিকারার্থে আমাদের দেশ ও জাতি যাতে ভোগ করতে পারে তার জন্যে উপরোক্ত কাজগুলো করাটা খুবই জরুরি আমরা মনে করি।
পরিশেষে আমরা মনে করি বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে সবার কাছে পরিগণিত হচ্ছে। আর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একজন ঝানু খেলোয়াড় হিসেবে দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে উজ্জল করার জন্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন যা অতীতে কারোর দ্বারাই এভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তাই আমাদেরকে দল-মত নির্বিশেষে ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা অবশ্যই কর্তব্য। আসুন জাতিকে বিভক্ত না করে আমরা একযোগে অধ্যাপক ইউনূসকে দেশ ও জাতির স্বার্থে সহযোগিতা করে যাই। লেখক- শিক্ষাবিদ