মো. মাঈন উদ্দীন
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল, যারা শরীয়াহভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে কাজ করে। জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য হলো আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসুল (সা.) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা। জামায়াতে ইসলামী সকল মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানায় এবং কুরআনের ভাষায় তাদেরকে দাওয়াত দেয়, “হে মানবজাতি, তোমরা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করো। আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মাবুদ নেই।” রাসূল (সা.) আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করেই এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, শাসন, বিচার, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই তিনি আল্লাহ্র বিধানকে চালু করে প্রমাণ করেছে যে, ইসলামই দুনিয়ার জীবনে শান্তির একমাত্র উপায়। তাই দ্বীন ইসলাম কায়েমের দায়িত্ব পালন করা অন্যতম গুরুত্মপূর্ণ কাজ । জামায়াত রাসুলুল্লাহর আদর্শ ও নীতিকে অনুসরণ করে দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকায় জামায়াতের জাতীয় সম্মেলন শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র জনগণ জামায়াত নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। আগামী দিনে দেশ পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সক্ষমতা নিয়ে দেশের গুণিজন, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ জণগণ ভাবনা শুরু করেছে। জামায়াতের আমির ডাঃ শফিকুর রহমানের সুন্দর, মানানসই ও উপযুক্ত শব্দচয়ন ইতোমধ্যে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। তিনি বেশ কয়েকটি জনসবায় বলেছেন জামায়াত যেভাবে সুশৃঙ্খল ভাবে দল চালাচ্ছে ক্ষমতায় গেলেও এর চেয়েও আরো সুশৃঙ্খল ও সততার সহিত দেশ চালাতে প্রস্তুত। এখন দেখার বিষয় হল দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের সক্ষমতা কতটা রয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছে যা হবে বৈষম্য হীন, দুর্নীতি মুক্ত ও টেকসই উন্নয়নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তা গঠন করতে হলে সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ নেতৃত্বের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জামায়াতের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কতটা রয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক:
১. নৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তি: একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী বিশ্বাস করে যে, ইসলামী নৈতিকতা ও শরীয়াহর কঠোর অনুশাসন দুর্নীতি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাজে সততা, আমানতদারিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কাজ করতে চায়।
২. আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৫৪ বছরে এদেশের জনগণ যে কয়েকটি সরকার দেখেছে সব সরকারেই আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতাও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে বড়ধরনের দুর্বলতা ছিল, নানা গরমিল ছিল। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে হলে আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কোন বিকল্প নেই। ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরী ও কালোটাকা নিষিদ্ধ। জামায়াতে ইসলামী এই নীতিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চায়। তারা জাকাত ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ কমাতে চায়।
৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা: বিগত সরকারগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতার বালাইছিল না। যাদের কাছে জবাবদিহি করবে তারা যদি নিজেরাই স্বচ্ছ না হয় তাহলে বিশৃংখলা ও গরমিলতো দেখা দিতে বাধ্য। জনগণ বিগত দিনে এসব দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। তাই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলের ও দেশের মধ্যে জবাবদিহিতা অনস্বীকার্য।
জামায়াতে ইসলামী অভ্যন্তরীণভাবে দলের সদস্যদের জন্য কঠোর শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে চায়, যেখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না।
৪. আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: বিগত স্বৈরাচারী সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হবে না। যতদূর দেখা যায় জামায়াত ইসলামী সংস্কার প্রসঙ্গে অনেক রাজনৈতিক দলের চেয়ে অধিক আগ্রহী। দলটি দুর্নীতি দমনে নানা সংস্কার প্রস্তাব করে যাচ্ছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে শক্তিশালী ও স্বাধীন করা। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারব্যবস্থার সংস্কার।সরকারি ক্রয়-বিক্রয় ও ঠিকাদারিতে স্বচ্ছ নীতিমালা প্রয়োগ।
৫. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: জামায়াতে ইসলামী মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে চায়। তারা ইসলামী শিক্ষার প্রসারকে নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
৬. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা ও সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপির যথেষ্ট সম্পর্ক রয়েছে যেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত ইসলামী পররাষ্ট্র বিষয়ে আগে থেকেই সচেতন। বিশেষ করে মুসলিম দেশ গুলোর সাথে জামায়াতের সুসম্পর্ক রয়েছে বটে তবে অমুসলিম দেশসমূহের সাথেও ইদানিং জামায়াতের সম্পর্ক ও যোগাযোগ অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক উন্নতির দিকে। জুলাই বিপ্লবের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ ১১টিরও বেশি দেশের কূটনৈতিকগণ জামায়াত ইসলামীর আমির ডাঃ শফিকুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভুটানও পাকিস্তানের প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক গণ বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাদের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। বহির্বিশ্বের সাথে জামায়াতের যোগাযোগ দিন দিন আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি জামায়াতের নেতৃবৃন্দ চীনের আমন্ত্রণে চীন সফর করে এসেছেন। এটা দেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
জামায়াতে ইসলামী দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তাদের মূলমন্ত্র হলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, ঘুষ-দুর্নীতির অবসান, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা, জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। এসব লক্ষ্য অবশ্যই অনেক উচ্চমার্গের, তবে বাস্তবায়নযোগ্যতা নির্ভর করে কৌশল ও নেতৃত্বের দক্ষতার উপর। দুর্নীতি মুক্ত অর্থনীতি গঠনের সক্ষমতার কথা বলতে গেলে বলতে হয় তারা ইসলামিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামী সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সুরক্ষায় জামায়াতে অবস্থান: জামায়াতে ইসলামী কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে দলটি ইসলামী সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং জাতীয় স্বাধীনতা সুরক্ষায় কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ সংগঠনটি রাজনৈতিক দর্শন ইসলামী শরিয়ার উপর ভিত্তি করে গঠিত। ইসলামী আইন, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জামায়াত ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা ও সংরক্ষণে সচেষ্ট। দলটি মাদরাসা শিক্ষা, ইসলামিক লিটারেচার প্রচার, ইসলামী সংগীত, সাহিত্য এবং পত্রিকাদ্বারা তরুণ প্রজন্মের মাঝে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে কাজ করে।
জামায়াতে ইসলামী পরিবারভিত্তিক সমাজ গঠনের পক্ষে এবং পশ্চিমা অপসংস্কৃতির বিরোধিতা করে থাকে। তারা নারী-পুরুষের ভূমিকা নির্ধারণে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দেয়।
জাতীয় স্বাধীনতা ও স্বার্থ রক্ষায় : জামায়াত দাবি করে, তারা সবসময় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তারা ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ মুসলিম বিশ্বের সংকটে ঐক্যের ডাক দিয়ে থাকে। প্রতিকূল সময়ে সংগঠন পরিচালনার সক্ষমতা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও দমন-পীড়নের মধ্যেও দলটি সংগঠন টিকিয়ে রেখেছে, যা তাদের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়।
বিগত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সহ চারদলীয় জোটের যে সরকার ছিল তখন জামায়াতের দুই জন মন্ত্রী ছিলেন যারা তাদের মন্ত্রণালয় পরিচালনায় সততা, একাগ্রতা , স্বচ্ছতার যে নজীর স্থাপন করেছেন তা কারো অজানা থাকার কথা নয়। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও দক্ষ ও টেকসই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের সক্ষমতা মূল্যায়ন ও তাদের নেতা, কর্মীদের দক্ষতা, সততা ও সুশৃঙ্খলার মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবির যে সুশৃঙ্খল সংগঠন তা মূল্যায়নে অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেক সুযোগ রয়েছে। গত ১৯ জুলাই ২০২৫ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের জাতীয় সম্মেলন শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও আনুগত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে সুদমুক্ত ব্যাংকিং, যাকাতভিত্তিক পুনর্বণ্টন, হালাল ব্যবসা ও শিল্পের উন্নয়নে মধ্যদিয়ে টেকসই ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠন করতে চায়। তবে এ ব্যবস্থাগুলো কেবল আদর্শিক নয়; বাস্তবে প্রয়োগ করতে হলে প্রচুর দক্ষতা, পরিকল্পনা ও সমর্থন দরকার, যা জামায়াতের আছে কিনা জনগণের মূল্যায়নের সময় এসেছে।
জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক ভিত্তি ও নীতিগত অবস্থান দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠনে সহায়ক। তবে, তাদের সক্ষমতা নির্ভর করে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা, জনসমর্থন ও বাস্তবায়ন কৌশলের উপর। বাংলাদেশের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হলেও, নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক।