মুসফিকা আন্জুম নাবা

সনাতনী, প্রচলিত ও প্রথাগত চিকিৎসা কম-বেশি পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের প্রথাগত চিকিৎসাকে ধর্মীয় প্রথাগত ও অধর্মীয় প্রথাগত দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, কালামি, বান্ধাই, আধ্যাত্মিক, জাদু টোনা, কবিরাজি, টোটকা ও গ্রাম্য চিকিৎসা। এর মধ্যে কবিরাজি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত চিকিৎসা। কবিরাজদের উৎপত্তি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে। মূলত, যারা সনাতনী পদ্ধতির ওষুধ ও চিকিৎসার চর্চা করেন তাদের কবিরাজ বলা হয়। কবিরাজি পদ্ধতি পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে প্রচলিত ও গ্রামগঞ্জে বেশ জনপ্রিয়। কবিরাজি চিকিৎসা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। এক সময় গ্রামগঞ্জে চিকিৎসার একমাত্র ভরসা ছিলেন কবিরাজরা। কয়েক দশক পূর্বেও আমাদের দেশে আধুনিক হাসপাতাল ও ওষুধ সহজলভ্য ছিল না।

তাই সাধারণ মানুষ রোগবালাই হলেই কবিরাজের কাছে ছুটে যেত। কালের পরিক্রমায় চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। ফলে কবিরাজের গুরুত্ব অনেকাংশে কমলেও এ পদ্ধতির চিকিৎসার প্রতি মানুষের আগ্রহ একেবারে হারিয়ে যায়নি। এখনো অনেক মানুষ বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে তাঁদের দ্বারস্থ হন।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া তথ্যমতে, দেশের অধিকাংশ রোগী এখনো রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের কাছে যান না। বরং তারা নির্ভর করেন হাকিম, কবিরাজ, ওঝা, টোটকাসহ ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসার উপর। বিশেষত গ্রাম-বাংলায় দরিদ্র বা অতি-দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা এসবে বেশি বিশ্বাসী। মানুষের এ সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কবিরাজের বেশ ধরে মানুষকে ঠকানোর কাহিনী দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে। ফলে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ চিকিৎসা প্রার্থীরা।

সাধারণত কবিরাজরা ধর্ম এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উপায়ে তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে নানা জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এদের নিখুঁত উপস্থাপনা; সহজ ও সরল মানুষরা এসব বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। এমনকি ঝাড়-ফুঁকের বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রভূত পরিমাণ অর্থ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। অনেকে প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোন। সাপের কামড়ে লাশ দাফনের আগে আগুনে ঝলসে জীবিত করার চেষ্টার নজিরও রয়েছে। এটা কুসংস্কার ও অমানবিকতার চরম পর্যায়। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, বন্ধ্যাত্ব, পছন্দের মানুষকে পাইয়ে দেয়া, অবাধ্য সন্তানকে নিয়ন্ত্রণে আনাসহ নানাবিধ সমস্যার সমাধান দেয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। এ কাজে কবিরাজ বা ফকিরের কাছে থাকা কথিত জ্বিন তাকে সহযোগিতা করে বলে রোগীদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়। বাড়িতে শত্রুতাবশত তাবিজ পুঁতে রাখা এবং এ কারণেই বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন এমন চটকদার কথা দ্বারা মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করে প্রতারণা করা হয়।

একই সাথে জ্বিনের সাহায্যে এসব তাবিজ বা মাটিতে তুলে এনে সমস্যার সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস নতুন কিছু নয় বরং এসব চিকিৎসার নামে অতিপুরনো উপখ্যান। এভাবেই চিকিৎসার নামে মানুষকে ঠকানো হয়। প্রকৃতপক্ষে জ্বিনের মাধ্যমে তাবিজ-কবজ তুলে আনার ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন উদ্দেশ্যপ্রণোগিত ও রীতিমত প্রতারণামূলক। মূলত, একশ্রেণির কথিত ও ভুয়া কবিরাজের কবিরাজি চিকিৎসার অন্যতম উপাদান হল উদ্ভট সব পন্থায় মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করা। একথা কারো অজানা নয় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেজাল ওষুধ ও অপেশাদার চিকিৎসকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে এসেও অনেক মানুষ এখনও ভূয়া কবিরাজের পেছনে ছুটে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছে। মরাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্যও। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রণায় সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ বিষয়ে খুবই উদাসীন।

আগের দিনে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় পরোক্ষভাবে মানুষ এগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিল এবং বংশ-পরম্পরায় এভাবেই চলে এসেছে মানুষ। তাই আধুনিক চিকিৎসা আসার পরও অবচেতন মনে জন্মজগতভাবে প্রথাগত ও সেকেলে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রয়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে চিকিৎসক থাকলেও একশ্রেণির মানুষ কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি এখনো খানিকটা আস্থাশীল। কারণ, তথাকথিত কবিরাজরা মানুষের কাছে নানাবিধ চটকদার কথা বলে তাদেরকে প্রভাবিত ও প্রতারিত করেন। একশ্রেণির মানুষের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল যে, আধুনিক চিকিৎসার চেয়ে ঝাড়ফুঁকই উত্তম পদ্ধতি ও অধিকতর ফলপ্রসূ। আর এ ভ্রান্ত ধারণা থেকেই তাঁদের মধ্যে অনেকেই ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবচের চর্চা করেন। প্রকৃতপক্ষে, যতটুকু আরোগ্য লাভ করেন রোগী সেটা ওইসব রোগীর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থেকে। অনেক সময় বলা হয় ফকিরের কেরামতি। আসলে এমন দাবির পক্ষে কোন যৌক্তিকতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ক্ষেত্রবিশেষে টোটকা চিকিৎসা নিয়ে অনেকে অন্ধত্ববরণ সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগে থাকেন।

দেশে শুধু সাধারণ রোগ নয়, ক্যান্সার, জন্ডিসের মত রোগের চিকিৎসাও করা হয় অবৈজ্ঞানিক ও অনুমোদিত পদ্ধতিতে। আর এ ধরণের অপচিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়। একশ্রেণির চিকিৎসক নামের প্রতারক এমন অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত। একশ্রেণির সরল বিশ্বাসী মানুষ সাপ কাটাসহ গুরুতর চিকিৎসা হাসপাতালে না করে কাবিরাজের কাছে যান। এ চিত্র যে প্রত্যন্ত গ্রামেই নয়, রাজধানী ঢাকাতেও এ ধরনের ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, কবিরাজি চিকিৎসার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের বিজ্ঞাপন দেখা যায় ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে। ইদানিং অনলাইনেও তারা সক্রিয়ভাবে প্রচার শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিতরাও এসব কথিত কবিরাজি চিকিৎসা নেন। অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করে যে, আধুনিক চিকিৎসায় সকল সমস্যার সমাধান নেই কিন্তু প্রথাগত চিকিৎসায় রয়েছে। সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, সুশিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্যতা ও বেকারত্বের কারণে কিভাবে স্বল্প সময়ে অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতাবান হওয়া যায় এমন চিন্তায় সবাই ব্যস্ত। এমন নেতিবাচক মানসিকতা থেকেই সর্বত্রই ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাব এখন অস্বাভাবিভাবে বেড়েছে। জরিপও বলছে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো আধুনিক চিকিৎসার বাইরেই আছেন; বিষয়টি যে আস্থার সংকট তা বলা যাবেনা বরং এর পেছনে সামাজিক, প্রচলিত বিশ্বাস ও রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। অর্থনৈতিক কারণও একটি বড় বিষয় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। দেশের অধিকাংশ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আমাদের দেশে প্রচুর প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এসব হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সেবা থাকলেও তা ব্যয়বহুল। তাই সাধারণ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে হওয়ায় অতিদরিদ্র শ্রেণি প্রচলিত টোটকা চিকিৎসার শরণাপন্ন হচ্ছেন। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ কবিরাজ, ওঝা, পানিপড়া বা তাবিজ কবজ করে থাকেন। কিন্তু এসব অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে এবং দেশের সার্বিক মৃত্যুহার বাড়ছে।

ভুয়া কবিরাজদের মাধ্যমে নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি কুমিল্লায় মা-মেয়ের ওপর সংঘটিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা দেশে চলা ভণ্ডামি, অজ্ঞতা ও মুর্খতার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। জিনের আছর থেকে মুক্তি পেতে, কবিরাজ নামক ভণ্ডের কাছে যাওয়া রোগীরা প্রায় ফাঁদে পরে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। মানুষের মধ্যে থাকা কুসংস্কার ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার ফসল এবং এগুলো সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

এ বিষয়ে সম্মিলিত প্রচারণার মাধ্যমে গণসচেতনা সৃষ্টি সময়ের দাবি। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণী বিশেষ করে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম, বিজ্ঞানের প্রাপ্ত জ্ঞান দ্বারা এসব অন্ধত্ব ও কুসংস্কার বন্ধ করা একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের বাস্তববাদী হওয়াও খুবই প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব কুসংস্কাচ্ছন, শঠ, অসৎ ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা দরকার। দেশে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা কোনভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।

লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট।