জসীমউদ্দীন ইতি
শিক্ষক হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ-যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করেন কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অজ্ঞতাকে ওদের হাতে তুলে দেন না।
শিক্ষকদের কাছে সারাবিশ্বের মানুষের মতো আমাদেরও চাহিদা তারা নতুন প্রজন্মকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলবেন। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনশীল, প্রয়োগমুখী ও উৎপাদন সহায়ক করে তোলা, শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা প্রদান করা’-কে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষক সমাজ জাতির এ প্রত্যাশা পূরণে প্রচেষ্টারত। কিন্তু শিক্ষক সমাজের প্রচেষ্টাকে নিয়ে সমাজে নানামত রয়েছে। সভ্যতার এবং শিক্ষার বিকাশে শিক্ষক হলেন কারিগর। তাই কারিগর দক্ষ এবং মানবিক না হলে শিক্ষা এবং সভ্যতার বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা যখন আমাদের শিক্ষা এবং শিক্ষকদের চিত্র দেখি তখন সেখানে দুর্ভিক্ষের ছবি ভেসে আসে। আমি লজ্জিত যখন দেখি আমাদের দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নেই, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নেই, শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণার কোন আগ্রহ নেই। যখন দেখি মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশাকে পাস কাটিয়ে যায়, শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণি বিভাজন, ছাত্রদের শোষণ, শিক্ষক নৈতিকতার মানদন্ড হারিয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে অধিক প্রাধন্য দিচ্ছেন, দায়বদ্ধতার পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলছেন তখন যারপর নাই বদানহত হই।
শিক্ষকদের আচরণে আজ দেখা যায় অনীহা, দায়িত্বহীনতা, পেশাগত অনাগ্রহ। অনেকে আবার শিক্ষার্থীদের শোষণের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চান-কখনো কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে, কখনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে। এ চিত্র শিক্ষক নামক পবিত্র পরিচয়ের অপমান এবং জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের রূপরেখা। শিক্ষকদের মধ্যে কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা তাদের মৌলিক কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত কাজের প্রতি অধিক মনোযোগী। আমরা ভুলে যাচ্ছি, শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়-এটি একটি ব্রত, একটি দায়িত্ব, একটি নৈতিক অঙ্গীকার। যদি শিক্ষকরাই নৈতিকতা বিসর্জন দেন, তবে শিক্ষার্থীরা কোথা থেকে শিখবে আদর্শ? যদি শিক্ষক সমাজই বিভাজনের ধারক হয়ে ওঠে, তবে ঐক্যবদ্ধ ও মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন আমরা কিভাবে দেখব? শিক্ষকদের মানসিকতা ও নৈতিকতা পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষক হতে হলে আগে মানুষ হতে হবে-এটা যেন প্রতিটি শিক্ষকের অন্তরে প্রোথিত থাকে। শিক্ষকতার মানোন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও মানবিকতা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা চাই, শিক্ষক হবেন একজন আলোকবর্তিকাÑযিনি নিজের আলোয় শিক্ষার্থীর পথ আলোকিত করবেন।
শিক্ষক হোন অনুপ্রেরণার উৎস, দায়িত্ববোধের প্রতীক, এবং মানবিক গুণাবলির মূর্ত প্রতিচ্ছবি। এ শিক্ষকরা যখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন, প্রতিযোগিতা, দলাদলি, এবং পদলিপ্সায় লিপ্ত হন-তখন শিক্ষার্থীরা শিখে নেয়, আদর্শ নয়, ব্যক্তিস্বার্থই সবচেয়ে বড়। ফলে তৈরি হয় এক আত্মকেন্দ্রিক ও মূল্যবোধশূন্য প্রজন্ম, যারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের বদলে কেবল সুবিধাবাদে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষা কোনো যন্ত্রগত প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি আদর্শগত আন্দোলন। আর এ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন শিক্ষক। যদি তিনি নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন, তবে পুরো জাতিই পথ হারায়। তাই প্রয়োজন শিক্ষককে পুনরায় ‘জাতি গঠনের কারিগর’ হিসেবে গড়ে তোলা-নেতৃত্ব, নৈতিকতা, এবং মানবিকতার মূর্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে। এমন চিত্র আমাদের ভাবতে বাধ্য করে-আমরা আদৌ একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের পথে রয়েছি তো? যদি শিক্ষকেরাই নিজস্ব সুবিধা ও স্বার্থ নিয়ে বিভক্ত থাকেন, তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একতা, মানবতা ও নৈতিকতা কীভাবে গড়ে উঠবে? শিক্ষা তখনই ফলপ্রসূ, যখন তা শুধু তথ্য নয়, আদর্শও দেয়; আর আদর্শ গড়ার প্রথম শর্ত হলো আদর্শ শিক্ষক।
দীর্ঘ দিনের রাজনৈকিত সংকট, রাজনৈতিক দূবৃত্তায়ন এবং আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি চিন্তার লালন ও পরিচর্চার কারণেই আজকে শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে গভীর সংকটের সৃষ্টি। এ অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তোলা-যেখানে শিক্ষকের সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়ই মূল্যায়নের আওতায় আসবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন শিক্ষক হবেন গর্বের প্রতীক, শ্রদ্ধার পাত্র এবং নৈতিকতার আলোকবর্তিকা। শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। নীতিনৈতিকতা, জবাবদিহিতা ও শিক্ষার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসাই হতে পারে একটি সুস্থ শিক্ষক সমাজের ভিত্তি। আর এ ভিত্তির উপরেই গড়ে উঠবে একটি সমৃদ্ধ ও সভ্য জাতি। তবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়-যদি আমরা চিহ্নিত সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে সমাধানমূলক দিকগুলো বিবেচনায় নেই।
প্রথমত, রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষকদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে। একজন শিক্ষক যেন শুধুমাত্র গরিবের পেশাজীবী হয়ে না থাকেন, তার জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই বেতন কাঠামো, যা তাঁকে অন্য পেশার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রাখতে সক্ষম। যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগে কঠোর মানদণ্ড প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রকৃত যোগ্য ও আদর্শবান ব্যক্তিরাই শিক্ষার দায়িত্ব পান। শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে শুধু পাঠদানের দক্ষতা নয়, নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও সমাজিক দায়িত্ববোধ থাকবে মূল্যায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশিক্ষণ কেবল ‘ফর্মালিটিতে’ সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না—তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের নিজস্ব সংগঠন ও প্রশাসনের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকরা যদি নিজেরা নিজেদের সম্মান না করেন, শ্রেণিবৈষম্য, দলাদলি আর অভ্যন্তরীণ হিংস্রতায় নিজেদের ক্ষয় না রোখেন—তবে বাইরে থেকে কেউ মর্যাদা দেবে না। পেশাগত শৃঙ্খলা ও সততা ধরে রাখার জন্য তাদের নিজেদের ভেতরেই আত্মসমালোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষক সমাজের মধ্যে একতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে—যাতে তারা বিভাজনের পথ পরিহার করে সহযোগিতার পরিবেশে শিক্ষার্থী গঠনে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। চতুর্থত, শিক্ষক প্রশিক্ষণকে সময়োপযোগী, বাস্তবভিত্তিক এবং নৈতিকতা-কেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু পাঠদানের দক্ষতা নয়, একজন শিক্ষককে হতে হবে নৈতিক আদর্শ, নেতৃত্বগুণ এবং সহানুভূতির প্রতীক। শিক্ষকদের শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ছাত্র কেবল একজন নম্বর অর্জনকারী নয়, বরং একজন মানবিক ও নৈতিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের আচরণ, কথাবার্তা, এবং মূল্যবোধ হবে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শ। শিক্ষা এবং শিক্ষকদের এ সংকট সমাধান খুব বেশি কষ্ঠসাধ্য বিষয় নয়। এখানে রাষ্ট্রের স্বদিচ্ছায় যথেষ্ট এবং সে স্বদিচ্ছা অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োগ নিশ্চিৎ করা। পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্ধ করা এবং তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সবশেষে, শিক্ষা প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের উচিত শিক্ষা ব্যবস্থায় দলীয়করণ বন্ধ করা। শিক্ষক যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার না হয়ে ওঠেন, বরং শিক্ষক হয়ে উঠবেন জাতি গঠনের আদর্শ ও নিরপেক্ষ দিশারী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাখতে হবে শিক্ষার উপযোগী, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং আদর্শ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে। আমরা যদি সত্যিই একটি সভ্য, মানবিক ও উন্নত জাতি গড়তে চাই, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, আর সে সংস্কারের শুরুটা হতে হবে শিক্ষককে কেন্দ্র করে-কারণ শিক্ষকই শিক্ষার প্রাণ।
লেখক : সাংবাদিক।