॥ জাফর আহমাদ ॥
আল্লাহ তাআলা বলেন,“আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা আরশের চারপাশে হাজির থাকে তারা সবাই প্রশংসাসহ তাদের রবের পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং ঈমানদারদের জন্য দু’আ করে। তারা বলে: হে আমাদের রব, তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছো। তাই মাফ করে দাও এবং দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করো, যারা তাওবা করেছে এবং তোমার পথ অনুসরণ করছে তাদেরকে। হে আমাদের রব উপরন্ত তাদেরকে তোমার প্রতিশ্রুতি চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও। আর তাদের বাপ মা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল (তাদেরকেও সেখানে তাদের সাথে পৌঁছিয়ে দাও)। তুমি নিসন্দেহে সবশক্তিমান ও মহাকৌশলী। আর তারেকে মন্দ কাজসমূহ থেকে রক্ষা করো। কিয়ামতের দিন তুমি যাকে মন্দ ও অকল্যাণসমুহ থেকে রক্ষা করেছো তার প্রতি তুমি বড় করুণা করেছো। এটাই বড় সাফল্য। (সুরা গাফির : ৭-৯)
আয়াতগুলো যদিও তৎকালীন দুর্দশাগ্রস্থ মু’মিনদের সান্তনার জন্য ছিল, যারা মক্কার কাফেরদের দ্বারা লাঞ্জিত, অপমানিত হচ্ছিলেন, বিদ্রুপ, কটুবাক্য ও অত্যাচার এবং তাদের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে দেখে ভগ্ন হৃদয় হয়ে পড়ছিলো। সার্বিকভাবে আয়াতগুলো সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। আজো যারা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর মিশণকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে তাদেরকে সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে এবং হতে হয়েছেও।
তাই বলা হয়েছে এসব নীচু ও হীন লোকদের কথায় তোমরা মন খারাপ করছো কেন। তোমরা এমন মর্যাদার অধিকারী যে, আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতারা এবং আরশের চারপাশে অবস্থানরত ফেরেশতারা পর্যন্ত তোমাদের সহযোগী তারা তোমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করছে। সাধারণ ফেরেশতাদেও কথা না বলে আল্লাহর আরশের ধারক ও তার চারপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ ধারণা দেয়ার জন্য যে, মহান আল্লাহর বিশাল সা¤্রাজ্যের কর্মচারীরা তো বটেই, তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানরত যেসব ফেরেশতা ঐ সা¤্রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ এবং বিশ^ জাহানের শাসন কর্তার কাছে যারা নৈকট্য লাভ করেছে তারা পর্যন্ত তোমাদের প্রতি গভীর আগ্রহ ও সমবেদনা পোষণ করে।
আরো বলা হয়েছে যে, ঈমানের এসব ফেরেশতা আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ কথা দ্বারা প্রকাশ পায় যে, ঈমানের বন্ধনই প্রকৃত বন্ধন যা আসমান ও যমীনবাসীদেরকে পরস্পর একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। এ সম্পর্কের কারণেই আরশের পাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের তাদের মতই আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান পোষণকারী মাটির মানুষের সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ফেরেশতাদের ঈমান গ্রহণ করেছে অর্থাৎ তারা এক ও লা-শরীক আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকেই স্বীকার করে নিয়েছে।
এমন আর কোন সত্তা নেই যে তাদের আদেশ দান করে আর তারাও তার আনুগত্য করে চলে। ঈমান গ্রহণকারী মানুষ যখন এ পথই গ্রহণ করলো তখন এত বড় জাতিগত পার্থক্য ও স্থানগত দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের এবং ফেরেশতদের মধ্যে একই দৃষ্টিভঙ্গিগত দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
ফেরেশতাদের দু’আর ভাষাও অত্যস্ত আবেগঘন, যদিও তাঁদের মানুষের মত আবেগ নেই। তাঁরা দু’আর ভাষা হচ্ছে তারা বলে: “হে আমাদের রব, তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছো। তাই মাফ করে দাও এবং দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করো, যারা তাওবা করেছে এবং তোমার পথ অনুসরণ করছে তাদেরকে।” অর্থাৎ তোমার বান্দার দুর্বলতা, বিচ্যুতি ও ভুল-ত্রুটি তোমার অজানা নয়। নিসন্দেহে তুমি সবকিছু জানো। কিন্তু তোমার জ্ঞানের মত তোমার রহমতও ব্যাপক। তাউ তাদের ত্রুটি বিচ্যুতি জানা সত্ত্বেও এই অসহায়দের ক্ষমা করে দাও।
আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, তোমার জ্ঞানানুসারে যাদের সম্পর্কে তুমি জানো যে, তারা সরল মনে তাওবা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তোমার পথ অবলম্বন করেছে, দয়া ও রহমত দিয়ে তাদেও সবাইকে ক্ষমা করে দাও।
ক্ষমা করা ও দোযখের আযাব থেকে রক্ষা যদিও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর একটি কথা বলার পর বাহ্যত অপর কথাটি বলার প্রয়োজন থাকে না। তবে এ বাচনভঙ্গি দ্বারা মূলত ঈমানদারদের প্রতি ফেরেশতাদের গভীর আগ্রহ প্রকাশ পায়। প্রজলিত নিয়ম হচ্ছে, কোন ব্যাপারে কারো মন যদি আকৃষ্ট হয় সে যখন শাসকের কাছে আবেদন জানানোর সুযোগ লাভ করে তখন একই আবেদনকে সে বার বার নানাভাবে মিনতি করে পেশ করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে একটি কথা একবার মাত্র পেশ করে সে তৃপ্তি ও সান্তনা পায় না। এ কথাটির মধ্যেও সেই মিনতি ভরা আবেদনের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান। এ কথা সুস্পষ্ট যে, ক্ষমা এবং দোযখ থেকে রক্ষা করা দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করার অর্থও আপনা আপনিই এবং অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পায়। তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা নিজে ঈমানদারদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মু’মিদেরকে সেটি দেয়ার জন্য দু’আ করা বাহ্যত অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয় কিন্তু ফেরেশতাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কল্যাণকামিতার এতটা আবেগ বিদ্যমান যে, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য একাধারে কল্যাণ কামনা করে দু’আ করে যাচ্ছে। অথচ তারা জানে, আল্লাহ তাদের প্রতি এসব অনুগ্রহ অবশ্যই করবেন।
আরো লক্ষণীয় যে, ফেরেশতাগণ মু’মিদেরকে এতটাই ভালবাসেন যে, মু’মিনগণ কিসে প্রশান্তি লাভ করে, সেটির জন্যও আল্লাহর কাছে দু’আ করতে কৃপণতা করেননি। মানুষের চক্ষুশীতলকারী হলো তাদের বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান। মহান আল্লাহ যেনো চক্ষু শীতল করার জন্য তাদেও মা-বাবা, স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিদেরও তাদের সাথে একত্রিত করে দেন। জান্নাতে ঈমানদারদেরকে যেসব নিয়ামত দান করা হবে তার বর্ণনা প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা নিজেও এ কথা বলেছেন। “তারা নিজেরা তার মধ্যে প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদারা ও স্ত্রী-সন্তানদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে তারাও তাদের সাথে সেখানে যাবে।” (সুরা রাদ : ২৩)
“যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাদের সন্তাননেরাও ঈমানসহ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমি তাদের সেসব সন্তানকেও তাদের সাথে একত্রিত করে দেবো।” (সুরা তুর : ২১) সুরা তুর এ কথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি জান্নাতের উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয় এবং তার মা, বাবা ও সন্তান সন্তুতি অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী নাও হয় তথাপি তাকে উচ্চ মর্যাদা থেকে না নামিয়ে বরং তার পিতা-মাতা ও সন্তান সন্তুতিকেই উচ্চ সর্যাদা দিয়ে তার পর্যায়ে উন্নীত করবেন।
ফেরেশতাগণ আরো দু’আ করেছেন, “আর তাদেরকে মন্দ কাজসমূহ থেকে রক্ষা করো।” মন্দ কাজ তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য। এক, ভুল আকীদা-বিশ^াস, বিকৃত নৈতিক চরিত্র এবং মন্দ কাজ কর্ম। দুই, গোমরাহী ও মন্দ কাজের পরিণাম। তিন, বিপদাপদ ও দু:খ কষ্ট-তা এ পৃথিবীতে হোক , আলমে বারযাখ বা মৃত্যুর পরের জীবনের হোক কিংবা কিয়ামতের দিনের হোক। ফেরেশতাদের দু’আর লক্ষ হলো, যেসব জিনিস তাদের জন্য অকল্যাণকর সেরূপ প্রতিটি জিনিস থেকে তাদেরকে রক্ষা করো।
কিয়ামতের দিনের অকল্যাণ অর্থ হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা ছাড়াও অন্যান্য আরাম আয়েশ ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, হিসেব নিকেশের কঠোরতা সমস্ত সৃষ্টির সামনে জীবনের গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার লাঞ্জনা ও অপমান এবং সেখানে অপরাধীরা আর যেসব লাঞ্জনা ও কষ্টের সম্মুখীন হবে তাও। সে লাঞ্চনা থেকে মু’মিনদের মুক্তি ও কষ্ট লাঘবের জন্য সম্মানিত ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর কাছে দু’আ করে থাকেন।
এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে মু’মিনদের বিভিন্ন আমলের জন্য ফেরেশতাগণ দু’আ করে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (সা:) থেকে এ ধরনের বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন অজু অবস্থায় ঘুমায় যে ব্যক্তি, সালাতের জন্য মসজিদে অপেক্ষমান ব্যক্তি, রাসুলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি দরূদ পাঠকারী, কলাণের পথে দানকারী, অন্য ভাইয়ের জন্য দু’আকারী ব্যক্তি, তাওবা করে আল্লাহর পথে চলন্ত ব্যক্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাদের জন্য ফেরেশতারা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
লেখক : ব্যাংকার।