॥ সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ॥
সম্প্রতি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তান ও সৌদি আরব একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা নিয়ে ভারতসহ এ অঞ্চলের সামনে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে পাকিস্তানের চিরবৈরী রাষ্ট্র খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না। এর নানা কারণও রয়েছে। মূলত সামরিক শক্তিতে এগিয়ে থাকলেও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। অন্যদিকে সৌদি আরব অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও সামরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। সৌদি আরব ও পাকিস্তান উভয়ই সুন্নি-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং তাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে।
সৌদি আরব অর্থনৈতিক সংকটের সময় পাকিস্তানকে বহুবার সাহায্য করেছে এবং বিনিময়ে পাকিস্তান সৌদি আরবকে নিরাপত্তা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে এসেছে বরাবরই। কিন্তু সাম্প্রতিক চুক্তিটি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এছাড়াও এ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যদি দু’দেশের মধ্যে যেকোনো একটি দেশের ওপর আক্রমণ করা হয়, তাহলে অন্য দেশও সেটিকে নিজের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবে। এর অর্থ দাঁড়ায় এখন যদি পাকিস্তান বা সৌদি আরবের ওপর কোনো হামলা হয়, তাহলে তা উভয় দেশের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। উভয় দেশের স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী এখন আরও বেশি সহযোগিতা করবে এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করবে।
মূলত, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক অস্ত্র-সমৃদ্ধ দেশ। তাই এটি উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের জন্য একটি নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরাইলের হামলা আরব বিশ্বে ক্ষোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে লড়াইয়ের পটভূমিতে এবং বর্তমান বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে সৌদি আরবের জন্য এ চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। যা দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
চুক্তির পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, আমাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক মোড় নিচ্ছে, আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।’ এ বিষয়ে সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ বলেছেন, ‘সৌদি আরবের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে পাকিস্তান আমেরিকান অস্ত্র কিনতে সক্ষম হবে।’ এদিকে পাকিস্তানি কূটনীতিক মালিহা লোধি এ চুক্তির পর বলেছেন, ‘এটি অন্যান্য আরব দেশগুলোর জন্যও দরজা খুলে দিয়েছে।’
এক বিশ্লেষণে বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক এলিজাবেথ থ্রেকহেল্ড বলেছেন, এ চুক্তি সৌদি আরবের কাছ থেকে জ্বালানি ও আর্থিক নিরাপত্তা পাওয়ার পাকিস্তানের সামর্থকে শক্তিশালী করবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সৌদি আরবের সঙ্গে এ চুক্তির ফলে পাকিস্তান অনেক বড় সুবিধা পেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুক্তাদির খান বলেন, ‘এটা পাকিস্তানের জন্য লটারি জেতার মতো।’
উল্লেখ, সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ভারতীয় পর্যটকদের প্রাণহানির পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাত দেখা দেয়। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া সামরিক পদক্ষেপের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সিন্দুর’ এবং যুদ্ধবিরতির পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন যে ‘অপারেশন সিন্দুর’ এখনো চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একতরফা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এখন ভারতকে ভাবতে হবে যে সৌদি আরব প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করবে কি না।
অবশ্য সৌদি আরব কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের আর্থিক সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে আসছে। অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ, ঋণ, তেল কেনার ক্ষেত্রে অনেক দিন পর মূল্য পরিশোধ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের মতো সুযোগ দিয়ে আসছে তারা। এ বছর সৌদি আরব পাকিস্তানকে ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল কেনার জন্য বিলম্বিত অর্থ প্রদানের সুবিধা দিয়েছে। একইভাবে ২০১৮ সালে সৌদি আরব পাকিস্তানকে ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল কেনায়ও একই ধরনের সুবিধা দিয়েছিল। সৌদি আরব পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ভারসাম্য বজায় রাখতে বেশ কয়েকবার সহায়তা করেছে। ২০১৪ সালে সৌদি আরব সরাসরি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার জমা দেয়। পরবর্তীতে ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সৌদি আরব পাকিস্তানকে ৩ বিলিয়ন ডলার করে দেয়। প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়াও পাকিস্তানকে ত্রাণ প্যাকেজও দিয়েছে সৌদি আরব এবং বিশাল বিনিয়োগও করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ প্রতিরক্ষা চুক্তির পরে সৌদি আরব থেকে আরও আর্থিক সাহায্য পেতে পারে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক হুসেন হাক্কানির ভাষ্যমতে বলেন, ‘পাকিস্তান এখন সৌদি আরবের অর্থ ব্যবহার করে তাদের প্রয়োজনীয় আমেরিকান অস্ত্র কিনতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনকেও অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।’
পাকিস্তান প্রতি বছর সৌদি আরব থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল কেনে এবং কখনো কখনো সৌদি আরব পাকিস্তানকে এর জন্য দেরিতে অর্থ পরিশোধের সুবিধাও দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংকটের সময়ে পাকিস্তান এখন সৌদি আরবের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এটি অনেক ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করবে। জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য পাকিস্তান সৌদি আরবের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই টানাপোড়েনের মধ্যেই চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ চুক্তির পর পাকিস্তানকে এ অঞ্চলে আরও গুরুতর শক্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে। চুক্তি ঘোষণার পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এক বিবৃতিতে বলেন, অন্যান্য আরব দেশের যোগদানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি এবং দরজা বন্ধও করা হয়নি। তিনি জিও টিভির সাথে এক আলাপচারিতায় আরও বলেন, এ চুক্তির অধীনে পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষমতার সুবিধাও পাওয়া যাবে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে অন্যান্য আরব দেশগুলোকে পাকিস্তানের সাথে অনুরূপ চুক্তি করার জন্য আমন্ত্রণ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুক্তাদির খান বলেন, ‘ইসরায়েলের আক্রমণের জবাব দিতে কাতার অক্ষম ছিল। আরব দেশগুলো অস্ত্রের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে, কিন্তু তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেক যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানকে একটি গুরুতর শক্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে।’ বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে এ চুক্তি আঞ্চলিক মঞ্চে পাকিস্তানকে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে।
মূলত, উভয় দেশের এমন প্রতিরক্ষা চুক্তির নেতিবাচক ও ইতবাচক দিক নিয়ে বিশ্লেষকরা নানামুখী মতামত প্রদান করছেন। এ চুক্তির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পেছনের কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, গালফের আরব রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা’ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে, ইসরাইল কর্তৃক কাতারে হামলার পর বিষয়টি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা বলেন, ‘এ চুক্তি বছরের পর বছর চলা আলোচনার সফল সমাপ্তি। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপ নয়, বরং আমাদের দু’দেশের দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর সহযোগিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদক্ষেপ।’
বস্তুত, এ চুক্তি সৌদি আরবের কৌশলগত অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্য করার দৃঢ় ইচ্ছাকে প্রতিফলন বরা যায়। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিয়াদ নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণে আরও স্বাধীনতা খোঁজার প্রয়াস পেয়েছে। আর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, পারমাণবিক সক্ষমতা এবং ভৌগোলিক কৌশলগত নৈকট্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সৌদি আরবের কাছে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এ চুক্তি থেকে সৌদি আরব এবং পাকিস্তান উপকৃত হলেও, এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ উলটপালট করে দিয়েছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানে সৌদি দূতাবাসের মিডিয়া অ্যাটাশে ড. জামাল আল হারবি বলেন, ‘এ চুক্তি উভয় অঞ্চলের নিরাপত্তা কৌশলকে পুনর্গঠন করতে পারে। আক্রমণের মুখে যৌথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৌদি আরব ও পাকিস্তান একটি স্পষ্ট প্রতিরোধী বার্তা পাঠাচ্ছে। এ প্রতিশ্রুতির ফলে এই দুই দেশের প্রতিপক্ষের জন্য শত্রুতার সম্ভাবনা কমতে পারে। কারণ তারা জানে যে প্রতিশোধের ক্ষেত্রে দুই শক্তিশালী দেশ একযোগে কাজ করবে।’
সৌদি-পাকিস্তান এ চুক্তির ফলে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একচ্ছত্র অধিপত্য ও নিরাপত্তা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে পারে। আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডের’ আওতায় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি আরবও সেই পথেই হাঁটছিল। একই পথে হাঁটছে সিরিয়াও। তবে গাজায় ইসরাইলের দু’বছর চালানো বর্বরতার কারণে সৌদি আরব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায়, পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের চুক্তি নিজেদের নতুন আত্মপরিচয় তৈরিরই প্রচেষ্টা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভালো হলেও, এ চুক্তি ওয়াশিংটনকে বিরক্ত ও বিব্রত করতে পারে।
পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মীর এ চুক্তিকে ভারত ও দেশটির অন্যতম মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানের ‘কৌশলগত বিজয়’ হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, এ যৌথ বিবৃতি দেখাচ্ছে যে এ চুক্তির গুরুত্ব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায়, এ চুক্তি প্রমাণ করছে যে পাকিস্তান নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, তাদের ভারত ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে।
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এসএমডিএ স্বাক্ষর আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। তবে এর প্রভাব কেবল সামরিক নয়, বরং বিনিয়োগ প্রবাহ ও বাজার স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এটি। এ আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তির ফলে, এক দেশের ওপর আক্রমণ অন্য দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব ও পাকিস্তান কেবল নিজেদের কৌশলগত মিত্রতা দৃঢ় করেছে না, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে পুনর্গঠনের সংকেত দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য, এ চুক্তি নতুন সুযোগের পাশাপাশি ঝুঁকিও তৈরি করছে। কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক করিডর, প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে। এ চুক্তি সম্পর্কে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ চুক্তি সৌদি আরবের নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা মিত্রদের বাইরে বিস্তৃত করার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে, যখন মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন আঞ্চলিক অস্থিরতা কমাতে পারে এবং গালফ ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
এ প্রতিরক্ষা চুক্তি ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের রিয়াদ সফরের সময় সৌদি আরব পাকিস্তানের খনিজ, কৃষি, অবকাঠামো এবং বিমান খাতে দু’বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। এ প্রকল্পগুলো সৌদি ভিশন ২০৩০ এবং পাকিস্তানের বিদেশি মূলধন আকর্ষণের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সৌদি বিনিয়োগ দেশের সবুজ শক্তিতে রূপান্তরকে দ্রুততর করতে পারে, আর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো ব্যবসা ও পর্যটন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। এ চুক্তি পাকিস্তানকে সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে একটি কৌশলগত সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, যা অবকাঠামো ও প্রযুক্তিতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ বাড়াবে। এটি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে (সিপিইসি) আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং নতুন বাণিজ্যিক রুট তৈরি করতে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারের স্থিতিশীলতাকে সহায়তা করবে। যদিও এ চুক্তি সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, এটি অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে জটিলতা তৈরি করছে। সৌদি আরবের ভারতীয় সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে তেল রপ্তানি ও বাণিজ্য চুক্তি, প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘ভারত এ ঘটনার বিষয়ে অবগত। আমরা এর প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব যে, এটি নয়াদিল্লির নিরাপত্তা ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।’
এক উচ্চপদস্থ সৌদি কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ককে ভারসাম্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগে কখনো এত দৃঢ় ছিল না। আমরা এ সম্পর্ককে আরও গড়ে তুলতে চলেছি এবং যেভাবেই পারি, অঞ্চলে শান্তির জন্য অবদান রাখার চেষ্টা করব।’ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সতর্ক কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা এ চাপ হ্রাস করতে পারে। কারণ উভয় দেশেরই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করার স্বার্থ রয়েছে।
সৌদি-পাকিস্তান এসএমডিএ কেবল প্রতিরক্ষা চুক্তি নয় এটি অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সংহতি গভীর করার মাধ্যমে, চুক্তি অবকাঠামো, শক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। এসএমডিএ দেখাচ্ছে কীভাবে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়।
তবে একথা সত্য যে, সৌদি-পাকিস্তানের মধ্যে এসএমডিএ চুক্তি যুদ্ধবাজ ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, এ চুক্তির ফলে কথায় কথায় প্রতিবেশীদের সাথে যুদ্ধ বাধার ব্যাপারে দেশটিকে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভাবতে হবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ ভারতীয় নিয়েও।