জালাল উদ্দিন ওমর
সুখরঞ্জন বালি, আজ বাংলাদেশের এক অতি পরিচিত নাম। গ্রামের সহজ সরল এবং সাধারণ একজন মানুষ। সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে অবিচল এবং অকুুতোভয় এক যোদ্ধা। সত্য প্রকাশ করতে চাওয়ায় তিনি অপহৃত, গুম, নির্যাতিত হয়েছেন এবং দীর্ঘদিন ভারতের কারাগারে জেল খেটেছেন। জীবনের হুমকিও পেয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই আপোষ করেননি। অর্থবিত্তের লোভনীয় অফার পেয়েছেন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করেছেন। কিছুতেই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়নি এবং দেয়নি। তিনি দৃঢ়তার সাথে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যেভাবে লড়াই করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। সুখরঞ্জন বালি নিজেকে সত্য, ন্যায় ও বিবেকের বলিষ্ঠ এক কন্ঠস্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, সম্মান এবং ভালবাসা।
সুখরঞ্জন বালির পরিচয় : সুখরঞ্জন বালি পিরোজপুর জেলার ইন্দুকানী উপজেলার উমেদপুর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় একজন কার্পেন্টার এবং হিন্দু ধর্মের অনুসারী। ১৯৭১ সালে তার ভাই বিশাবালীকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী সরকারের সময় পিরোজপুর-১ আসনের দু’বারের সংসদ সদস্য এবং জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে আসামী করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা করা হয়। সুখরঞ্জন বালি তার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কারা তার ভাইকে হত্যা করেছে, তা তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। এ মামলায় তিনি সত্য ঘটনা তুলে ধরতে চেয়েছেন। সুখরঞ্জন বালি ¯পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সাঈদী সাহেব তার ভাই বিশাবালিকে হত্যা করেনি এবং তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সাথে কোনভাবেই জড়িত নন। সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য সরকারের লোকজন তাকে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে কিছুতেই রাজি হয়নি এবং বলেছেন সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ট্রাইবুনাল এলাকা হতে সুখরঞ্জন বালির অপহরণ : ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর তিনি সাঈদীর মামলায় প্রকৃত ঘটনা বর্ননা করার জন্য ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের গেইটের সামনে সাদা পোশাকধারী পুলিশের সদস্যরা সুখরঞ্জন বালিকে বহনকারী গাড়ি আটক করে এবং গাড়ি থেকে তাকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তাকে রাজধানীর একটি অজ্ঞাত স্থানে প্রায় দু’মাস চোখ বেঁধে আটকে রাখা হয় এবং প্রচণ্ডভাবে শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ভারতে পাচার করা হয় এবং বিজিবির সহায়তায় ভারতের পশ্চিম বঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার অন্তর্গত বৈকারী বাজার সীমান্তে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয়। বিএসএফ তাকে প্রচণ্ডভাবে মারধর করে এবং বশিরহাট সাবজেলে ২২ দিন আটক রাখে। এরপর তাকে দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়। সে কারাগারে প্রায় ৫ বছর আটক থাকার পর মানবাধিকার সংস্থা এবং ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সহায়তায় সুখরঞ্জন বালি ভারতীয় কারাগার হতে মুক্তি পায় এবং দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরও তিনি নিরাপত্তার কারণে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেনি এবং বিভিন্ন জেলায় গোপনে অবস্থান করেন। সুখরঞ্জন বালিকে অপহরনের ঘটনা সেদিন ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা হলেও, ট্রাইবুনাল তা আমলে নেয়নি। অথচ সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব ছিল।
ট্রাইব্যুনালে সুখরঞ্জন বালির অভিযোগ : ঘটনার এক যুগের ও বেশি সময় পর গত ২১ আগষ্ট সুখরঞ্জন বালি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ পত্র জমা দেন। অভিযোগ পত্রে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার পথে ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের গেইট হতে তাকে অপহরণ করে গুম, নির্যাতন এবং ভারতে পাচার করা হয়। এ ঘটনায় সুখরঞ্জন বালি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাঈম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ,সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, ট্রাইব্যুনালের সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএম আউয়াল,সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলি, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত এবং তৎকালীন তদন্ত সংস্থার প্রধান মো: সানাউল হক সহ ৩২ জনের জন্য বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেছেন। সুখরঞ্জন বালি বলেন, তাকে গুম, অপরহরণ এবং ভারতে পাচার, সবই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। তিনি বলেন, তাকে শারিরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লংঘন এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ। তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, অপহরণ, ভারতে পাচার এবং ভারতের জেলে ৫ বছর অবৈধ কারাভোগ সহ তার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া সকল অন্যায়ের বিচার দাবী করেন। তার অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগ পত্রে রয়েছে।
অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক : শুধুমাত্র মিথ্যা সাক্ষ্য না দেয়ার কারণে সুখরঞ্জন বালি চরমভাবে রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অথচ তার পুরস্কার পাওয়ার কথা এবং তাকে পুরস্কৃত করারই দরকার ছিল। মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করাটা যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব,সেখানে উল্টো তৎকালীন রাষ্ট্র ন্যায় বিচার হরণ করেছেন। এখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিতের পরিবর্তে রাষ্ট্র অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের লালনের পরিবর্তে রাষ্ট্র এখানে দুষ্টকে লালন এবং শিষ্টকে দমন করেছেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে সংবিধান লংঘন করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং আমানতের খেয়ানত করেছেন। তারা ন্যায় বিচারকে গলা টিপে হত্যা করেছেন এবং নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছামত রায় দিয়েছেন। একজন সাধারণ নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং অবিচার কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সুতরাং এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতে হবে। সুখ রঞ্জন বালির অভিযোগ অতিদ্রুত আমলে নিয়ে বিষয়টির সঠিক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করা হউক। যারা দোষী তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হউক।
সুখরঞ্জন বালিকে ক্ষতিপূরণ এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হোক : ভাই বিশাবালি হত্যাকাণ্ডে জড়িত করে মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় সুখরঞ্জন বালি চরমভাবে রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের শিকার হয়েছেন। সুখ রঞ্জন বালি বলেন, নিজ চোখে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ভাইকে হত্যার ঘটনা দেখেছি। সেখানে সাঈদী সাহেব ছিলেন না। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন তার ভাইকে হত্যার জন্য সাঈদী সাহেবকে দায়ী করে সাক্ষী দিতে বলেন,যা শতভাগ মিথ্যা। কিন্তু সুখরঞ্জন বালি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়নি। ফলে তাকে অপরহরণ, শারিরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন এবং ভারতের কারাগারে ৫ বছর আটকে রাখা হয়। এতে সুখরঞ্জন বালি সবদিক দিয়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। কোন ধরনের অপরাধ না করা সত্ত্বেও তিনি শারিরিক-মানসিক ভাবে নির্যাতিত এবং আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তার পরিবারও অনেকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং অর্থ কষ্টে দিন পার করেছেন। সুতরাং তাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপুরন দেয়া হউক। পাশাপাশি সত্যের প্রতি অবিচল থাকার জন্য সুখরঞ্জন বালিকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করা হউক।
সুখরঞ্জন বালি, সত্য-ন্যায় ও বিবেকের কন্ঠস্বর : মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার বিনিময়ে সুখরঞ্জন বালিকে অর্থ বিত্তের প্রলোভন দেয়া হয়েছিল। আবার মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সকল প্রকার লোভ লালসাকে প্রত্যাখান করেছেন এবং জীবনের হুমকিকে তুচ্ছ করেছেন। সত্যের প্রতি এরকম অবিচল আস্থা এ সমাজে বিরল। স্বার্থের জন্য এ সমাজের অগনিত মানুষ যখন সত্যকে বিক্রি করে দেয়, সেখানে সুখরঞ্জন বালি সত্যের জন্য নিপিড়ন নির্যাতনকে সানন্দে আলিঙ্গন করেছেন। সমাজের অসংখ্য উচ্চ শিক্ষিত এবং ধনী ব্যক্তিরা যেখানে স্বার্থের জন্য সত্যকে বিক্রি করে মিথ্যাকে গ্রহন করে, সেখানে গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত এবং নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখরঞ্জন বালি, সত্যের প্রতি অবিচল থাকতে দু:খ কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করেছেন। সুখরঞ্জন বালির মত সমাজের সবাই যদি ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশে অবিচল থাকত এবং সত্য প্রকাশ করত তাহলে সমাজ থেকে অবিচার অনাচার বহু আগেই বিদায় নিত এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা পেত। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলিম আলেমের প্রতি তার যে ভালবাসা, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা তা তাকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে ওঠে মানবতার গান গেয়েছেন। সুখরঞ্জন বালি আজ নিজেকে সত্য, ন্যায় এবং বিবেকের কন্ঠস্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার জীবন থেকে মানুষের অনেক কিছুই শেখার আছে।
লেখক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক।