লুৎফুন্নাহার

বিশ্ব অর্থনীতি আজ এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় যে মার্কিন ডলার ছিল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক, সে ডলারের আধিপত্য এখন প্রশ্নের মুখে। অর্থনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, হাইব্রিড অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির বিকাশ-সব মিলিয়ে এক নতুন মুদ্রা রাজনীতির সূচনা হয়েছে। এ পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “ডলারহীনতা” (De -dollarization) বা ডলারের বাইরে বৈশ্বিক লেনদেনের প্রসার। তাহলে কি তবে ডলারের দাপট শেষ হতে চলেছে?

ডলারের আধিপত্যের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিশ্বের দেশগুলো তখন থেকে আন্তর্জাতিক লেনদেন, বাণিজ্য ও রিজার্ভ রাখার জন্য ডলার ব্যবহার শুরু করে। মূল কারণ ছিল-

০ মার্কিন অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থান,

০ সোনার মানের সাথে ডলারের সরাসরি সংযোগ,

০ আমেরিকার রাজনৈতিক প্রভাব।

দীর্ঘদিন ধরে ডলারের এ একচ্ছত্র আধিপত্য বিশ্ব বানিজ্য, তেল ব্যবসা, বৈদেশিক ঋন - সবখানেই প্রভাব বিস্তার করছে।

ডলারের আধিপত্যে ফাটল ধরার কারণ :

সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েকটি ঘটনা ও প্রবণতা ডলারের শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

০ যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা নীতি : ইরান, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা - বহু দেশই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলারভিত্তিক লেনদেন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এতে তারা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

০ চীনের উত্থান ও ইউয়ানের প্রসার : চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তারা তাদের মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয়।

০ ব্রিকস (BRICS) দেশগুলোর উদ্যেগ : ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা-এ পাঁচ দেশের সংগঠন বৈশ্বিক লেনদেনে নিজস্ব মুদ্রা বা বিকল্প ব্যাংকিং সিস্টেম গড়ে তুলতে কাজ করছে।

০ ডিজিটাল ক্যারেন্সির আগ্রাসন : ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি ( ঈইউঈ) ডলার নির্ভর অর্থনীতিকে নতুন প্রতিদ্বন্দিতা দিচ্ছে।

০ মার্কেট ঋণ সংকট : যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ঋণের পরিমান বেড়ে যাওয়া ডলারের প্রতি আস্থাকে কিছুটা দুর্বল করেছে।

ব্রিকস : ডলার বিরোধী একটি অর্থনৈতিক ব্লক : ব্রিকস দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ২৫% নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সম্মিলিত পদক্ষেপে ডলারের প্রভাব কমানোর প্রচেষ্টা এখন সবচেয়ে আলোচিত।ব্রিকস ডলারের বিকল্প হিসেবে একটি অভিন্ন মুদ্রা তৈরির কথা বলেছে। এমনকি সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা - এমন আরো দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে চায়, যা ভবিষ্যতে ডলারের দাপটকে আরো চ্যালেন্জ করতে পারে।

ডিজিটাল কারেন্সি : নতুন যুগের মুদ্রা যুদ্ধ :

চীনসহ অনেক দেশ নিজেদের সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি চালু করেছে। এসব ডিজিটাল মুদ্রা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে দ্রুত প্রভাব ফেলেছে। আবার বিটকয়েন, ইথেরিয়ামসহ ক্রিপ্টোকারেন্সিও ডলারের বিকল্প হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। যদিও এগুলো এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত বা স্বীকৃত নয়, তবে এগুলোর সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।

ডলারের দাপটের শেষ কি সত্যিই হবে? হয়তো ‘শেষ’ শব্দেটি অতিরঞ্জিত, তবে নিঃসন্দেহে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন আর আগের মতো নেই। বিশ্ব অর্থনীতি এখন বহুমুখী, গতিশীল এবং প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে ডলার তার প্রভাব কিছুটা হারালেও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন মুদ্রা রাজনীতি এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।