কানাডার পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিবেশী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কট্টর বিরোধী মার্ক কার্নি বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের এমন ফলাফলে বিশ্লেষকরা বলতে গেলে নড়েচড়ে বসেছেন। কার্নির বিজয় এখন আর খবর নয়। খবর হচ্ছে পতনোন্মুখ দলটি কানাডায় কিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিজয় অর্জন করলো। আর কিভাবে ট্রাম্পের মোকাবেলা করবে সে ভাবনাও উপেক্ষা করার মত নয়।
কার্নির দলের বিজয়ের কারণ কী? প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পরপরই কানাডা দখলে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এটা হাস্যরস সৃষ্টি করলেও ট্রা¤প ছিলেন নির্বিকার। তিনি কানাডার তখনকার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সাথে বৈঠকেও একই কথা বলেন। আর বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন। ট্রাম্পের এসব কথা বার্তা দেশটির নাগরিকদের ভিন্নভাবে ভাবতে সহায়তা করেছে। জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরোধিতার সূত্রটি আরো ব্যাপক হয়। শেষ পর্যন্ত জাস্টিনকে বিদায় নিতে হয়। জাস্টিন নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও তার দলই জিতে যায়। বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, তাঁর দেশ কখনো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতিস্বীকার করবে না। দেখা যাচ্ছে পুরনো পথেই হাঁটতে চাইছেন দলটির নতুন নেতা কার্নি। এ নিয়ে টানা চতুর্থবার কানাডার ক্ষমতায় লিবারেল পার্টি।
কানাডার পাবলিক ব্রডকাস্টার সিবিসি নিউজের অনুমান, মার্ক কার্নির লিবারেল পার্টি হাউস অব কমন্সে সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন পাবে। সিবিসি বলছে, ৩৪৩টি আসনের মধ্যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কিনা তা এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে তারাই পরবর্তী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
কেন নির্বাচনের ডাক দিলেন কার্নি? দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই লিবারেল পার্টির বর্তমান নেতা মার্ক কার্নি মার্চে নির্বাচনের ডাক দেন। এ দৌড়ে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ নেতা পিয়েরে পোলিয়েভ্রে। নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর গত মাসে কানাডার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়, তখন লিবারেলদের আসন ছিল ১৫২টি এবং কনজারভেটিভদের ছিল ১২০টি আসন। বাকি আসনগুলো ব্লক কুইবেকোইস (৩৩), নিউ ডেমোক্র্যাট পার্টি (২৪) এবং গ্রিন পার্টির (২) দখলে ছিল। ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এবারের নির্বাচনে লিবারেলের আসন বেড়ে হয়েছে ১৬৯টি। আগের চেয়ে ১৭টি বেশি। আর কনজারভেটিভের আসন ১৪৩, বেড়েছে ২৩টি। কুইবেকরা পেয়েছে ২৩টি আসন, গত নির্বাচনের চেয়ে ১০টি কম। নিউ ডেমোক্রেটের আসন ৭টি, আসন কমেছে ১৬টি। আর গ্রিন পার্টিরও একটি আসন কমেছে।
বাংলাদেশের সাথে কানাডার সম্পর্কের নিরিখে কানাডার নির্বাচন ও পরবর্তী ঘটনাবলী বেশ গুরুত্ব বহন করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দু’দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ, যার গভীরতা গত পঁয়তাল্লিশ বছরে আরো বেড়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা লাভের সময় রাজনৈতিক সম্পর্ক যাত্রা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কানাডা সরকার, জনগণ এবং মিডিয়া বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল। কানাডা সে সকল দেশের মধ্যে একটি যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর পরেই ১৯৭২ সালে মে মাসে বাংলাদেশ কানাডায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে, এবং কানাডা বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জাস্টিন ট্রুডোর পিতা পিয়েরে ট্রুডোর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশ দেশটির অনেক সহযোগিতা ও আনুকূল্য পেয়েছে। এরপর থেকে দু’দেশের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। রাজনৈতিক সম্পর্কও কমনওয়েলথ এবং নানাবিধ ইউএন কর্মকাণ্ডে বরাবরের মতই সহযোগিতামূলক ছিল। বাংলাদেশের উন্নয়নে কানাডার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে শিগগিরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে সংলাপ শুরুর সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কানাডার একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছেন। এ চুক্তি দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণে সহায়ক হবে বলে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে কানাডার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাণিজ্য প্রতিনিধি পল থপিলের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়েও বৈঠকে স্থান পেয়েছে। কানাডার একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পল। এ সময় বাংলাদেশী পণ্যের জন্য কানাডার শুল্কমুক্ত কোটা সুবিধার প্রশংসা করেন পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়াও চলমান বিদেশী বিনিয়োগ সুরক্ষা ও উন্নয়ন চুক্তি (এফআইপিএ) নিয়ে আশা প্রকাশ করেন। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ তিনশ’ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় সন্তোষ জানায় উভয় দেশ। এ প্রসঙ্গে পল বলেন, ‘এফআইপিএ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তার দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও বাড়বে।’ রোহিঙ্গাদের জন্য কানাডার মানবিক সহায়তা চলমান রয়েছে। কার্নির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক আগামীতে আরো উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।
কানাডা উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত একটি উন্নত রাষ্ট্র। কানাডা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি। আর এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। দেশটি অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এবং জি ৮ গ্রুপের সদস্য। এর দশটি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। কানাডার অধিকৃত ভূমি প্রথম বসবাসের জন্য চেষ্টা চালায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ। পঞ্চদশ শতকের শুরুতে ইংরেজ এবং ফরাসি অভিযাত্রীরা আটলান্টিক উপকূল আবিষ্কার করে এবং পরে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রের প্রধান রাজা তৃতীয় চার্লস ও রাষ্ট্রের সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী।
ফিরে আসি কানাডার নির্বাচন ও পরবর্তী প্রসঙ্গে। এখন কী বলছেন কার্নি? এএফপি জানাচ্ছে, কানাডার অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন ঘোষণা দেন। মার্ক কার্নি বলেন, ‘বড় কিছু করার জন্য আমি রাজনীতি করছি, বড় কিছু হওয়ার জন্য নয়। কানাডাবাসী আমাকে দ্রুত বড় পরিবর্তন আনার অধিকার দিয়েছেন, আমি নিরলসভাবে সে আস্থার মর্যাদা রক্ষা করব। নির্বাচনে লিবারেল পার্টি ১৬৯টি আসন পায়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ছিল ১৭২টি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও কার্নি সরকার পার্লামেন্টে যেকোনো আইন সহজে পাস করতে পারবে। দু’টি হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী এলাকায় ভোট পুনর্গণনা করা হয়। এর মধ্যে কুইবেকে হারলেও অন্টারিওতে আরেকটি নতুন আসন পায় লিবারেল পার্টি। এ অবস্থার মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন মঙ্গলবার। ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন বিষয় ফয়সালা করার চেষ্টা করার কথা জানান তিনি। কার্নি বলেন, ‘কানাডার নাগরিকেরা আমাকে নির্বাচিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য। আমি মনোযোগ ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করব। আমাদের মনোযোগ থাকবে তাৎক্ষণিক বাণিজ্য চাপ মোকাবিলার ওপর। একই সঙ্গে দুটি সার্বভৌম দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কের দিকেও আমরা মনোযোগ দেব।’ তবে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেই বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য করেন কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী।
কানাডার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কারোপ এবং দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করার পর থেকে দু’প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। কানাডার সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও ট্রাম্পের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাদের মধ্যে তীব্র দেশপ্রেমের জোয়ার ওঠে। এতে ভোটের আগমুহূর্তে কানাডার নির্বাচনী পরিবেশ পুরোপুরি বদলে যায়। ভোটের আগে ট্রাম্পের বক্তব্য এবং তাঁর কর্মকাণ্ড কানাডায় প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্পের বক্তব্যের জেরে নিজের নির্বাচনী প্রচারে কার্নি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এতে লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কার্নির প্রতি জনসমর্থন বেড়ে যায়। ভোটের দিনও যার প্রতিফলন দেখা গেছে। সে কথা আগেও বলেছি। কানাডার প্রধান বিরোধীদল কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী পিয়েরে পলিয়েভর নিজের হার মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, খুবই সামান্য ব্যবধানে হলেও কার্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট আসনে জিতে গেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বছরের শুরুতে দেশটিতে আবাসন খরচ বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান অভিবাসনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগের পর লিবারেলদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অর্থনীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নাগরিকরা। ফলে তাদের মাঝে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। সঙ্গত কারণেই লিবারেলদের পতনমুখী অবস্থার অবসান হয়- যা দলটিকে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে। বেশ কিছুদিন ধরে কানাডা জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ট্রাম্পের ব্যাপক শুল্কারোপের হুমকি ও উত্তর আমেরিকার গাড়ি নির্মাতাদের কারখানা কানাডা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা দেশটির অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এতে অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে।
কানাডায় ভোটাররা সরাসরি তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন না। ভোটাররা ৩৪৩টি নির্বাচনী জেলায় কেবল হাউস অফ কমন্সে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। হাউস অফ কমন্সে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, সে দলের নেতা সরকর গঠন করবে এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে যদি কোনো দলই প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে জয়লাভ করতে না পারেন, তাহলে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দল বিরোধী অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবে। তবে বিরল ঘটনা হলো- দুই বা ততোধিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি করে জোট সরকার গঠন করতে পারে। তবে ১৬৯ আসন পাওয়ায় কার্নির দলকে সরকার চালাতে বেগ পেতে হবে না।
নির্বাচনের দিন কানাডার নাগরিকদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপহাস করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, তিনি নিজেই ব্যালটে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হওয়া উচিত কানাডার। যুক্তরাষ্ট্র ভুলবশত কানাডাকে ভর্তুকি দেয় বলেও দাবি করেন তিনি। পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘‘কানাডা রাজ্য না হওয়াটার কোনো মানে নেই। মনে করা হচ্ছে কার্নি এসব প্রশ্নের আরো খোলামেলা জবাব দেবেন এবং তার দেশকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করবেন। আগামী দিনগুলোতে তা আরো স্পষ্ট হবে।