ড. বি এম শহীদুল ইসলাম
প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এ বছরও গত ৫ আগস্ট দিবসটি বেশ ধুমধামের সাথে পালিত হয়ে গেল। শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে সম্মানের সাথে বিবেচনা ও যথাযথ স্বীকৃতি দিতে এবং তাদের পেশাগত অধিকার, মর্যাদা ও আর্থ-সামাজিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। আমারা বলে থাকি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ বলা উচিত ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ শিক্ষকগণ জাতির কারিগর, পথ প্রদর্শক ও সমাজের আলোকবর্তিকা। শিক্ষক ব্যতীত কোনো জাতি কখনো উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে না। জ্ঞানার্জন, জ্ঞানচর্চা ও প্রসারের মাধ্যমেই সভ্যতার সত্যিকার বিকাশ সাধিত হয়। আর সে জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছেন সকল স্তরের সম্মানিত শিক্ষকগণ। এ জন্য শিক্ষককের সম্মান ও মর্যাদা সব সময় সমুন্নত রাখার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। আমাদের জানা মতে, ইসলামী বিধান শিক্ষা এবং শিক্ষককে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে। অজ্ঞতা হচ্ছে-অন্ধকারের শামিল। অন্ধকার ও অজ্ঞতা মানুষকে পশ্চাৎপদ করে রাখে। আর জ্ঞান মানুষকে বিবেকবান করে তোলে। মানুষকে দীপ্তিময় করে উন্নত ও মর্যাদাবান করে তোলে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়, জাহেলি যুগে আরব সমাজ ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অজ্ঞতার সমাজ। সেখানে শিক্ষিত মানুষ ও শিক্ষার আলোকবর্তিকা না থাকার কারণে সমাজে বিরাজমান ছিল হিংসাত্মক কুসংস্কার, দাম্ভিকতা এবং অমানবিক আচরণবোধ। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও ঘৃণা সে সময় সমাজকে কলুষিত করে তুলেছিল। ঠিক সে সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রথম যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা হলো ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন কর। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ এ আয়াতেই এসেছে শিক্ষা, কলম আর পাঠ করার নির্দেশনা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিখিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ [সুরা আলাক:১-৫]।
মহান আল্লাহর এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। ইসলাম পরিপূর্ণ রূপে জ্ঞানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে এবং জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। আমাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, শিক্ষকতা নিছক কোন চাকরি বা শুধু একটি পেশা নয়, বরং জাতি গঠনের এক মহান দায়িত্ব। যে দায়িত্ব পালন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সমতুল্য কাজ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে-আল্লাহ বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি কখনো সমান হতে পারে?’ [সুরা জুমার: ০৯]। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ সাধন করা হয়েছে।’ [সুরা বাকারা:২৬৯ আয়াত]। এ থেকেই সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, জ্ঞান ও জ্ঞানদাতা তথা শিক্ষকের মর্যাদা কতটা উচ্চ পর্যায়ে। শিক্ষকগণ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল ব্যাপক সমাদৃত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আদব, বিনয়ী, ভদ্রতা, নম্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা কর। তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান কর, যার নিকট থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর। সুতরাং যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয় তিনি হচ্ছেন-আমাদের মুকুটতুল্য শিক্ষক। শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে বাদশাহ আলমগীরের দৃষ্টান্ত আমাদের কারো অজানা নয়। তবে শিক্ষকের মর্যাদায় ইসলামের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও সংক্ষিপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
একদা হযরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা) তার সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাব বা পা-দানিতে পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরেন। হযরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই! আপনি রেকাব থেকে হাত সরিয়ে নিন। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, না। আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’ জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথ নির্দেশ করতে পারে। হাদিসে বর্ণিত, আমাদের রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে অর্থাৎ আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি’। আমাদের প্রিয়নবী (স.) শিক্ষক ও শিক্ষার সম্প্রসারণে সব সময় সচেতন ও সচেষ্ট ছিলেন। তাই রাসুল (সা.) বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির মানসে তাদের সাথে মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেয়ার চুক্তি করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বন্দীদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম নিজ স্থান থেকে সরে তাকে জায়গা করে দেন। তখন তিনি এরশাদ করেন, যারা ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। [জামেআত তিরমিযি]।
সর্বসাধারণের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অত্যন্ত সম্মান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। আর ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অতিরিক্ত সম্মানিত ও মহান পেশা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক বিবেচনায় শিক্ষকতা পেশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও মহান এ পেশাকে আমাদের নাব্য সোসাইটিতে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। যা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক আচরণ। আবার অনেক শিক্ষককে দেখা যায়, শিক্ষকতার এ মহান পেশাকে কলঙ্কিত করে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়ে, যা অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্জনীয় কাজ। অথচ প্রিয়নবী (স) হাদিসে সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া কেউই আমার আপন নয়।’ [সহীহ হাদিস]।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আজ বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন মানসম্মত শিক্ষক তৈরির সংকট, অন্যদিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে কতটা যোগ্য ও নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষক সে জাতিকে তৈরি করতে পেরেছে তার ওপর। ইসলামে যেমন ভালো শিক্ষক হওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধাশীল হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে প্রয়োজন, প্রত্যেকটি শিক্ষক যেন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। সভ্যতা, সততা, নৈতিকতা, শিষ্টাচার, চরিত্র গঠন, সৎ জীবনযাপন ও মাধুর্য দিয়ে তিনি যেন সমাজে, রাষ্ট্রে ও শিক্ষার্থীর কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন। আবার রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব হলো শিক্ষকের যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা, তাদের সঠিক সম্মান ও আর্থ-সামাজিক প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা। যাতে তারা তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা নিয়ে বেঁচে থাকতে উৎসাহ বোধ করে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল বার্তা হচ্ছে- ‘অন্ধকারের অবস্থান থেকে আলোর পথে অগ্রযাত্রা’। শিক্ষককে সম্মান করা মানে শিক্ষাকে সম্মান করা। আর শিক্ষাকে সম্মান করার অর্থই হচ্ছে-দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়া। ইসলাম জ্ঞান ও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ আসনে স্থান করে দিয়েছে-বিধায় শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা মুসলিম সমাজের অন্যতম অপরিহার্য দায়িত্ব। তাই আমাদের প্রাণবন্ত প্রতিজ্ঞা হোক, শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে মর্যাদার আসনে বসানো এবং শিক্ষকের নেতৃত্বে সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ গ্রহণ ও পরিচালিত করা। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও মহান শিক্ষক। ইসলামের সুমহান শিক্ষার আহ্বান মানুষের নিকট পৌঁছানোর কারণে তাকে সীমাহীন লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, যা কল্পনাতীত। তারপরও তিনি শিক্ষার আলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গোটা বিশ্বকে আলোকিত ও বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ পেয়েছে শান্তির এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান।
অতএব এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার হোক, শিক্ষকের প্রতি যথাযথ মর্যাদার অঙ্গীকার ও সর্বোত্তম আদর্শের অনুসারণ। শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, নৈতিকতা, ন্যায়বিচার ও সত্যের অনুসরণ এবং অন্যায়, অসত্য, চাঁদাবাজ ও ফ্যাসিবাদের বর্জন। আসুন, আমরা বিশ্ববাসী মহানবীর (স)-এর আদর্শের সুমহান শিক্ষা মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ইসলামী আদর্শের মডেল হিসেবে গড়ে তুলি। যাতে করে মানব রচিত কোনো মতবাদের শিক্ষা এদেশের সবুজ-শ্যামল পবিত্র ভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।